বিহারের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে দক্ষিণ এশিয়া

ভারতের অভাবী মানুষ কী ভাবছে, সেটা বোঝা যাবে

বিহার ভারতের দারিদ্র্যপ্রধান একটি প্রদেশ। তা হলেও বছরের এই সময়টায় বিহার সচরাচর আনন্দমুখর থাকে। দুর্গাপূজা, দেওয়ালি, নবরাত্রি, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী ইত্যাদি পর্ব থাকে অক্টোবর-নভেম্বরে। কিন্তু এবার সেখানে মানুষের মনে শান্তি নেই। এর বড় কারণ বন্যা ও করোনায় চরম মন্দার শিকার হওয়া রাজ্যের অর্থনীতি।

তাই নির্বাচনেও প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে বেকারি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে মহামারিতে অর্থনৈতিক মন্দা যাচ্ছে। সর্বত্র বেকারত্ব বেড়েছে কয়েক গুণ। বিহারে এর তীব্রতা খানিক বেশি। মহামারির শুরুতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কয়েক লাখ বিহারি শ্রমিককে নিজ রাজ্যে ফিরতে হয় খুবই অল্প সময়ের নোটিশে—অবমাননাকর অবস্থার শিকার হয়ে।

অন্য রাজ্যে কাজ করা মানুষদের আয় বিহারের অর্থনীতির প্রধান শক্তি। চলতি অভাবী অবস্থার ফল ভোটের দিন কী দাঁড়ায়, সেটা দেখা দক্ষিণ এশিয়ার সব শাসকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

রাজ্যের এত দিনকার মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জন্যও এটা চূড়ান্ত এক পরীক্ষা। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় তিনি। বিজেপির সমর্থনে টিকে আছেন এখন। দরিদ্র মানুষেরা এক ব্যক্তির দীর্ঘ শাসনকে কীভাবে দেখে, তারও একটা পরীক্ষা হচ্ছে বিহারে।

ভোটের গণিতে দলিত-মুসলমানরা বড় নির্ধারক

নীতিশ কুমারের বড় ভরসা বিজেপি। তাঁর ‘ঐক্যবদ্ধ জনতা দল’-এর সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্রীয় শাসক দল। কিন্তু দলিত ও মুসলমানরা আগের মতো কতটা তাঁর সঙ্গে থাকবে, তা অনিশ্চিত। নির্বাচনের ফলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই দুই জনগোষ্ঠী। দলিত ও মুসলমানদের নির্বাচনী মনোভাব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও মনোযোগের বিষয়। উত্তর প্রদেশে উচ্চবর্ণের ঠাকুরদের দ্বারা দলিত নারীদের ধর্ষণের ঘটনায় ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। এর মধ্যে আবার বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হলো কিছুদিন আগে। এই দুই ঘটনা বিহারে কীভাবে প্রভাব ফেলে, সেটা দেখার দর্শকও কম নয়।

দলিতরা রাজ্যে ভোটের প্রায় ১৬ ভাগ। অন্যদিকে, মুসলমানরা ৮০টি আসনে ভোটের ফলাফল প্রভাবিত করতে সক্ষম। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এ রকম ভোটগুলো কোন দিকে যায়, সেটা দেখার বিষয়ই বটে। তবে আজকাল দলিত ও মুসলমানদের সব ভোট এক দল পায় না। তাদের ভোটের ভাগ-বাঁটোয়ারা থেকে বরাবরই লাভবান হয় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রধান দল বিজেপি। বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশের প্রধান মিত্রও তারাই।

বিজেপির কৃষিনীতির প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা

চরম দারিদ্র্যের পাশাপাশি ভারতের গ্রামীণ দারিদ্র্যের অনুপাতের দিক থেকে বিহার প্রথম এক–দুটির মধ্যেই পড়ে। এ অবস্থায় বিজেপি সরকার সম্প্রতি পার্লামেন্টে যে কৃষিবিল পাস করল, তার প্রতি গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়াও বোঝা যাবে বিহারে ভোটে। নতুন আইনে কৃষি খাতে বড় ব্যবসায়ীদের আগমন ‘সহজ করা হয়েছে’। ব্যবসার অনেক পুরোনো বিধিনিষেধ সরানো হয়েছে। এখন থেকে কৃষিপণ্য বেশি করে গুদামজাত করা এবং যথেচ্ছ বিক্রিবাট্টা করা যাবে। আরও সরাসরি বললে কৃষিপণ্যকে বিজেপি অনেকটাই এবার ‘বাজার’-এর ওপর ছেড়ে দিল, যে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে বড় বিনিয়োগকারীদের হাতে। বিরোধী দলগুলো বলছে, সাধারণ কৃষকেরা প্রতিযোগিতায় মার খাবে এতে। বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণই আর থাকছে না তাদের পক্ষে। পাইকারি বাজারে এত দিন সরকার কৃষকদের সুবিধার জন্য যে হস্তক্ষেপ করত, নতুন আইনের কারণে সেটাও আর থাকবে না। তারা মনে করছে, এ আইনি সংস্কারের মাধ্যমে পণ্য বাজার থেকে বিধিনিষেধ তুলে মজুতদারি ও কালোবাজারিকে ছাড় দেওয়া হলো।

কৃষি ও খাদ্যশস্য বাজারকে এভাবে খুলে দেওয়ার নীতি ভারতের আশপাশের দেশগুলোতেও আসি আসি করছে বহুদিন। বিহারের নির্বাচন শেষে কিছুটা অনুমান করা যাব, সেসব দেশে কৃষিজীবীরা এ রকম আইন কীভাবে নিতে পারেন। এ কারণে দরিদ্র বিহারের নির্বাচন ঘিরে এবার বহুজাতিক ব্যবসায়ী জগতেও মৃদু আগ্রহ গড়ে উঠেছে। তাদের এই আগ্রহ ও স্বার্থের ছাপ আছে প্রচারমাধ্যমেও।

বড় বড় ভারতীয় মিডিয়া দেখাতে চাইছে বরাবরের মতো এবারও বিজেপি জোটের সঙ্গে অ-বিজেপি জোটের লড়াই হচ্ছে—এই নির্বাচনের আর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই। ইস্যুর চেয়েও আলোচনায় রাখা হচ্ছে নীতিশ কুমার, লালু প্রসাদ যাদব প্রমুখ ব্যক্তিদেরই। কিন্তু বাস্তবে সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে বিহারের এই নির্বাচনের গুরুত্ব তুমুল।

সমীকরণ কি পাল্টাতে পারে?

রাজনৈতিক চেতনায় পিছিয়ে থাকা জনপদগুলোয় এসব কৌশল সাধারণত ব্যর্থ হয় না। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনেই নীতিশ-বিজেপি জোট বিহারের ৪০টি আসনের ৩৯টি পেয়েছিল। অবিশ্বাস্য এক বিজয় ছিল সেটা।

বামপন্থী দলগুলো সেই সমীকরণ পাল্টাতে চাইছে এবার। কিন্তু মোটেই সবল নয় তারা। গত বিধানসভায় তাদের মাত্র তিনজন প্রতিনিধি ছিল। এবার এই দলগুলো জোট করেছে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে। দুর্নীতির দায়ে লালু এখন রাঁচি জেলে আছেন। তাঁর দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুত্র তেজস্বী যাদব। জনতা দলের ভোটব্যাংক যাদব ও মুসলমানরা। বামরা কাজ করছে প্রধানত দলিত চামার-মুশহরদের মধ্যে। এই তিন গোষ্ঠী ভোটের ৩৫ ভাগের মতো। এই তিন পুঁজি একত্র করে এই জোট নীতিশ কুমার-বিজেপি মোর্চাকে হারাতে চায়। সঙ্গে আরেক শরিক কংগ্রেসও আছে। শিগগির মেয়াদ শেষ হতে চলা ২৪৩ আসনের বিধানসভায় লালুদের আসন ছিল ৮০টি। কংগ্রেসের ২৭টি।

অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ভোটব্যাংক কুর্মি, কৈরি ও দলিতদের একাংশ। উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং বানিয়ারা হলো বিজেপির সমর্থক। ভোটের গণিতে এই উভয় শক্তি বাজি ধরছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাসিন্দার ওপর।

নীতিশ-বিজেপি জোট মানেই কুর্মি-কৈরি-দলিত-উচ্চবর্ণ-বানিয়াদের অবিশ্বাস্য এক ভোটের অঙ্ক (৫+৮+৫+২০)। গত নির্বাচনগুলোয় এ রকম হিসাব অনুযায়ী ভোট হয়েছে। সঙ্গে ছিল মোদিজির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ঢেউ, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে লোকসভা নির্বাচনে। প্রশ্ন হলো অর্থনৈতিক নাজুকতা, জায়গায় জায়গায় দলিত-মুসলমান নিপীড়ন, মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং লাদাখে সৈন্য খোয়ানোর পরও কি মোদি-জাদু কাজ করবে? পুরো দক্ষিণ এশিয়াই নতুন করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। বিহারে ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনে তিন দফা ভোট শেষে আগামী ১০ নভেম্বর ফলাফল ঘোষণা শুরু হলে ওই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। তত দিনে ট্রাম্পের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে যাবে! বিহার থেকে ওয়াশিংটন প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উভয় নির্বাচনের কিছু গড় সামাজিক যোগসূত্র তো থাকছেই।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।

শেয়ার করুন: