চাকরির বয়সসীমা না বাড়ালে বিপদে পড়বে লাখো তরুণ-তরুণী

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাস পেরিয়ে গেছে দেশে। এর মাঝে অনলাইনে পড়ালেখার চেষ্টা হয়েছে। তাতে পাঠের কাজ খুব বেশি এগোয়নি। কিন্তু সময় তো বসে নেই। থেমে নেই। দেশের তরুণ প্রজন্মের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের একাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে যারা গ্রাজুয়েশন স্তরে আছে। প্রায় পরিবারে এরকম ২-১ জন আছেন। তাদের অবস্থা দেখলে মায়া লাগে। একদিকে তরুণ বয়সটায় তারা ঘরে বা পাড়ায় বন্দি—অন্যদিকে ভবিষ্যত নিয়ে আশাহীন একটা অবস্থায় চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অনিবার্য এক সেশনজটের কবলে পড়েছে এই জনগোষ্ঠী। এরকম অবস্থাতেই চাকরির আবেদনের বয়স বাড়ানোর কথা উঠেছে।

বেসরকারি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এখন। কিন্তু চাকরির বাজারে তরুণদের কাছে রাষ্ট্রীয় খাতেরই আকর্ষণ বেশি। এরকম চাকরি প্রত্যাশীদের জীবন থেকে হঠাৎ করে প্রায় দেড় বছর সময় হারিয়ে গেল। চাকরির বয়সসীমা না বাড়ালে স্নাতক স্তরে আটকে থাকা অনেকেই মুশকিলে পড়বে।

বিপদে আছে স্নাতক শেষ করার দলও। মহামারির কারণে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকখানি অনুপস্থিত। উল্টো কাজ হারানোর নজিরই বেশি। রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি বড় বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গত দেড় বছরে লোক নেয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে অতি অল্প। ধীর লয়ে সাধারণ বিসিএস-এর দুটি প্রক্রিয়া চলছে। তাতে হয়তো হাজার চারেক তরুণ-তরুণী কাজ পাবে। ব্যাংক খাত থেকেও কিছু নিয়োগের নোটিশ এসেছে। আর তেমন কোথাও কিছু নেই।

এরকম অবস্থায় যারা মারির আগে-আগে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পেরিয়েছে তাদের বড় অংশই কমবেশি ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছে। এদের মাঝে যারা ২০২০-এর শুরুতে ২৭-২৮ বছর বয়সী ছিল তারা চাকুরির আবেদনে বয়সজনিত বাধার শিকার হবে শিগগির। এরকম তরুণ-তরুণীর সংখ্যা লাখ লাখ। এদের জন্য ২-৩ বছর বাড়তি সময় জরুরি। চাকুরিতে আবেদনের বয়সসীমা একটু বাড়ালে এরা আগামীতে বিভিন্ন দিকে আরও কিছুদিন দরখাস্ত করতে পারবে। নচেৎ উল্টোটি ঘটবে। যার আলামৎ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। অল্প পদের কিছু চাকরিতে ইদানিং আবেদন কম পড়তে দেখা যাচ্ছে। যা বেকারত্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেকেই এসব কাজে আবেদন করতে পারছে না বয়স বেড়ে যাওয়ায়।

সরকারি কিছু কিছু নিয়োগে ২০০০ সালের মার্চ পরের সময়কে ‘করোনাকাল’ ধরে বয়সের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার নজির শুরু করলেও সবাই সেটা অনুসরণ করেনি, করছে না। বেসরকারি খাত একদম অনুসরণ করছে না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে সেটা স্থায়ী সমাধান নয়। তরুণদের প্রত্যাশা, সরকারকে ঘোষণা দিয়ে বয়সের হিসাব খানিক এগিয়ে নিতে হবে। তা না হলে দ্রুতই সর্বত্র আবেদন করার সুযোগ হারাতে হবে তাদের।

চাকরির সীমা বাড়ানো-কমানোর সঙ্গে সকল দেশেই কিছু বিজ্ঞানসম্মত বিবেচনা কাজ করে বা করা উচিত। এটা যেমন শ্রম বাজার পরিস্থিতির সংগে সম্পর্কিত তেমনি মানুষের জীবনের দৈর্ঘ্য হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গেও সম্পর্কিত। বাংলাদেশে অনেক খাতে ইতোমধ্যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়ানো হয়েছে। কোথাও কোথাও অবসরের বয়সসীমারও বাড়ছে।
এসবই সুচিন্তিত পদক্ষেপ। ২-৩ দশক আগে পেশাগত জীবন শুরু ও শেষের যে বয়সসীমা ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা একই রকম থাকা সঙ্গত হতে পারে না। তখন গড় আয়ু যত ছিল—তার চেয়ে এখন সেটা অনেক বেড়েছে। ফলে মানুষ পেশাগত জীবনে এখন অধিকসময় দিতে সক্ষম। সেই হিসাবেও কর্মজগতে প্রবেশের সময়সীমা কিছু শিথিল করার সুযোগ আছে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচনাটি অবশ্যই বেকারত্বের প্রকোপ। মহামারি কর্মসংস্থানের পরিসর অনেক সংকুচিত করে ফেলেছে। যা সরকারের এতদিনকার অর্থনৈতিক উদ্যোগসমূহকে ম্লান করতে উদ্যত। যার এক ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, সাগর-মহাসাগর থেকে এ বছর বিদেশে কাজ প্রত্যাশী বিপুল বাংলাদেশিকে অসহায় অবস্থায় উদ্ধার করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন অনুশীলনের সঙ্গে এসব বাস্তব ছবি খাপ খায় না।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তরুণরা যে ইউরোপ-আমেরিকায় ঢুকতে চাইছে সেটা অবশ্যই সম্মানজনক একটা কাজের আশায়। দেশে তেমন সুযোগ থাকলে এদের কম সংখ্যকই হয়তো অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশ করতে চাইতো। এরকম পরিস্থিতি তরুণদের উপায়হীন অবস্থাকেই নির্দেশ করছে।

আমরা জানি দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখের মতো নতুন মানব সম্পদ কাজের খোঁজে নামে। মহামারির দুই বছরেও এরকম ৪০ লাখ হাজির—কিন্তু তারা কী খুঁজবে, কোথায় যাবে? আরেক বছর পেরেলোই পুরানোদের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন ২০ লাখ।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, বেকারত্বের এই প্রকোপের সুযোগ নিতে বিশেষভাবে তৎপর হয়েছে বেসরকারি খাত। তারা সচেতনভাবে অধিকাংশ পদে বেতন কমিয়ে লোক চাইছে। উপায়হীন অবস্থায় অনেক তরুণ-তরুণী সেই কাজ নিতে বাধ্য হচ্ছে। শোষণের এই নতুন শৃঙ্খল থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে সরকারকে জোরেশোরে এগিয়ে আসা দরকার। একদিকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদগুলো পূরণে উদ্যোগী হওয়া দরকার এবং তাতে আবেদনের বয়সসীমাও বাড়ানো দরকার।

*প্রথম প্রকাশিত ২০২১ সালে, ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ নামের অনলাইনে।

শেয়ার করুন: