চিলিতে নেরুদার পুনর্জন্ম!

উত্তর আমেরিকার ‘বাদশা’ একটু দুর্বল হওয়া মাত্র দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে পরিবর্তনের নতুন ঢেউ উঠেছে এমুহূর্তে।

মাত্র কয়েকদিন হলো বলিভিয়ায় জনগণ তাদের নেতা এভো মরালেসকে উৎখাতের বদলা নিলো শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। এ সপ্তাহে চিলিতে ঘটেছে আরও যুগান্তকারী ঘটনা।

কুখ্যাত পিনোশের আমলে তৈরি সংবিধান পাল্টানোর জন্য যে গণভোট হলো তাতে ৭৮ ভাগ মানুষ পক্ষে (‘এপ্রুভ’) রায় দিয়েছে। নীচের ছবিতে ঐ এপ্রুভ শ্লোগান লেখা পতাকা হাতে চিলিয়ানদের উল্লাস করতে দেখা যাচ্ছে সান্টিয়াগোর রাস্তায়।

গণভোটের রায় অনুযায়ী, চিলিতে এবার জনগণের প্রতিনিধিরাই সংবিধান লিখতে পারবে। বহু বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর চিলিবাসী এই ঐতিহাসিক মুহুর্তটি তৈরি করতে পারলো।

অনেকেরই হয়তো মনে আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে সালভাদর আলেন্দের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৭৩ সালে জেনারেল পিনোচে চিলিতে কীভাবে দুঃশাসনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বিশ্বজুড়ে অনেক বই লেখা হয়েছে এই ক্যুতে মার্কিন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। মূলত আমূল সামাজিক রূপান্তরবাদীদের নির্মূলের লক্ষ্যে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সরাসরি সংশ্লিষ্টতায় ঐ ক্যু সংগঠিত করা হয়েছিল। ওর পর দু’লাখ রাজনৈতিক কর্মীকে নির্বাসনে যেতে হয়। হাজার হাজার সংগঠক নিখোঁজ হয়েগিয়েছিল পিনোশের ১৭ বছরের শাসনে। আলেন্দের বন্ধু নোবেলজয়ী কবি পাবলো নেরুদাকে পর্যন্ত গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। পরে রহস্যময়ভাবে মারাও যান তিনি।

এর মাঝেই, ১৯৮০ সালে চিলির সামরিক শাসকরা তাদের মনোনীতদের দ্বারা লিখিত একটা সংবিধান চাপিয়ে দেয় দেশে। সামরিক শাসকদের সাজানো এক নির্বাচনের মাধ্যমে ঐ সংবিধান কায়েম করা হয়েছিল। যে সংবিধান চিলিবাসীকে অনেক ধরনের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বিশেষত এই সংবিধান নিয়ে দেশটির আদিবাসীদের বিশেষ আপত্তি ছিল।

সংবিধান তৈরির জনআন্দোলন ছিল সাম্প্রতিক চিলিতে একইসঙ্গে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও যা হবে জনতার কাছে জবাবদিহিতাপূর্ণ। ২০১৯ সালে চিলিজুড়ে বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের বিরুদ্ধে দুনিয়ার নজড়কাড়া যেসব সমাবেশ হয়েছে তারই একটা ফল হলো নতুন সংবিধানের জন্য গণভোট। ঐসব সমাবেশের একটা বড় এজেন্ডা ছিল সামাজিক অসাম্য কমানো। যে অসাম্যের অন্যতম গোড়া প্রোথিত ছিল এতদিনকার সংবিধানে।

গণভোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল দুটি: সংবিধান কি পুরোপুরি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা লিখবে? নাকি নির্বাচিত এবং মনোনীতদের মিশ্র একটা ব্যবস্থায় সেটা লেখা হবে? জনগণ রায় দিয়েছে– কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সংবিধান প্রণয়ন করুক।

বর্তমান গণভোটের পর চিলিতে শুরু হবে নির্বাচিত সংবিধানসভার অধীনে নতুন সংবিধান লেখার পালা। আগামী বছর হবে সংবিধানসভার প্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচন।

২০২২ সালে সেই সংবিধান অনুমোদনের জন্য আবার ভোট হবে। অর্থাৎ এবার সংগ্রামের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলো চিলি। এই পুরো অধ্যায়ের মধ্যদিয়ে চিলি সালভাদর আলেন্দেকে হারানোর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বদলা নিতে চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা এক মহাকাব্যিক প্রতিশোধ হতে চলেছে।

এ যেন নেরুদার পুনর্জন্ম! রাজনীতি জনগণের অংশগ্রহণ পেলে কবিতার মতোই বাঙময় হওয়ে ওঠে বৈকি!!

*প্রথম প্রকাশিত হয় ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামের জার্নালে, ২০২০ সালে।

শেয়ার করুন: