আলতাফ পারভেজ। খ্যাতিমান গবেষক ও সাংবাদিক। ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’ বইয়ের মাধ্যমে তিনি বাঙলাদেশের ইতিহাসচর্চায় খুলে দিয়েছেন নতুন দিগন্ত। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে তার লেখালেখি গবেষক ও সমালোচকদের নজর কেড়েছে। ‘শ্রী লঙ্কার তামিল ইলম: দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকট’ তার এ বিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ।
মায়ানমারে রোহিঙ্গা সঙ্কটের আশু সমাধানের কোন সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আরাকানের বিদ্রোহী গেরিলাগোষ্ঠীর সাথে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আরাকান সমস্যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান সমস্যা। আরাকান সঙ্কটের উৎপত্তি, কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব এবং বাঙলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের করণীয়—এসব নিয়েই মূলত আলাপ হয়েছিল তাঁর সাথে। ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরের পাঠকদের জন্য সেই আলাপটাই পত্রস্থ হলো।
মিয়ানমারের সঙ্কট এখন তো আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নাই। এখন আরাকান আর্মির সাথেও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে, রাখাইনরাও পালাচ্ছে। আরাকানের মূল সঙ্কটটা কোথায়?
আলতাফ পারভেজ: আসলে বার্মার সংকট কখনোই রোহিঙ্গা সংকটে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা দেশটির সামগ্রিক এবং বহুমাত্রিক সংকটের একাংশ মাত্র।
বার্মার প্রথম এবং প্রধান সংকট হলো দেশটির বামার জনগোষ্ঠীর একাধিপত্য। দেশটি বহু জাতিসত্তার দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে বামার জাতি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে।
স্বাধীনতার সময়ে অন্যান্য জাতির স্বায়ত্তশাসন ও পৃথক হওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে জেনারেল অং সাঙ যে ‘ইউনিয়ন’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন বার্মা তা থেকে বহুদূরে সরে গেছে। এটাই তার প্রধান সংকট। দেশটির খনিজ সম্পদের সুবিধাও বামাররাই প্রধানত ভোগ করছে।
বামারদের এই একাধিপত্যের একটা সামরিক ও প্রশাসনিক দিকও রয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী পুরোপুরি বামারপ্রধান। তারা বহুদশক ধরে দেশটি শাসন করেছে। সেখানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চরমভাবে অবিকশিত। আবার এখন কথিত গণতন্ত্র এলেও পার্লামেন্টারি ব্যবস্থাটি এমন যে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ২৫ ভাগ আসন নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় (স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত, প্রতিরক্ষা) তাদের জন্যই সুরক্ষিত। এভাবে বর্তমান আমলেও মূলত পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীর প্রভাবেই দেশটি চলছে। আবার সিভিল সরকারও বামারপ্রধান। অন্যদিকে, এইরূপ এক জাতিতান্ত্রিক একটা কাঠামোর পক্ষে চীন দীর্ঘদিন ধরে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এখন তাতে ভারত, জাপান প্রমুখ দেশও জুটেছে। এর ফলে বেসামরিক শাসনামলেও দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হচ্ছে না। বামারপ্রধান সেনাবাহিনী তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে উগ্র বৌদ্ধবাদীদের জড়ো করছে। এই উগ্রতার প্রসারের প্রতীকী টার্গেট হিসেবে নেয়া হয়েছে মুসলমান ঘৃণার প্রসারকে। অর্থাৎ বামার সিভিল-মিলিটারি চক্র মুসলমান ঘৃণাকে ব্রান্ডিং করেই তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চেষ্টা করছে। এর মাঝে তারা অ-বামার প্রায় সকল প্রধান জাতিসত্তার বিরুদ্ধেই কমবেশি যুদ্ধাবস্থাও জারি রেখেছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটে অনেকেই ‘পলিটিকাল ইকোনমি’র তত্ত্ব-তালাশ করেছেন। কিন্তু অনেকেই এটাকে ‘কাভারিং’-ও বলেছেন, তাদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার ধর্মীয় দিকটা উপেক্ষাযোগ্য নয়। আপনার কী মনে হয়, রোহিঙ্গাসঙ্কট ও বর্তমানের আরাকান-সঙ্কট একই সূত্রে গাঁথা? এই দুই ঘটনার মধ্যে মিল বা অমিল মূলত কী কী?
আলতাফ পারভেজ: রোহিঙ্গা সংকটের বৃহত্তর রাজনৈতিক দিকটি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে খানিকটা। বার্মার মিলিটারি এবং অনেকাংশে অং সাঙ সুচির বেসামরিক প্রশাসনও মুসলমান বিদ্বেষী। বিগত নির্বাচনে কোন দল থেকেই কোন মুসলমানকে প্রার্থী হতেও দেয়া হয়নি। জাতীয় পর্যায়ের বৃহত্তর মুসলমান ঘৃণার প্রধান এক পরিসর আরাকান। তবে আরাকান থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাড়ানোর আরও বৃহত্তর পলিটিক্যাল ইকোনমিও আছে। চীন ও ভারত সেখানে বিশাল আকারে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করছে। চীন সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর করেছে। ইকোনমিক জোন করেছে। আরাকান থেকে তার মূল ভূখন্ড পর্যন্ত জ্বালানি পাইপলাইন করেছে। অন্যদিকে ভারত সেখানে তাদের দেশের বাইরের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে। ‘কালাদন প্রকল্প’ যার নাম। এটা একটা বিশাল বিনিয়োগ। ওখানে ইকোনোমিক জোনও করছে ভারত। এসব কারণে ঐ অঞ্চল থেকে দরিদ্র রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর প্রয়োজন ছিল হয়তো। অর্থাৎ একদিকে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে মুসলমান ঘৃণা এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রয়োজন হিসেবে নিরুপদ্রব ভূমি—এই দুইয়ের মিলিত ফল হিসেবেই রোহিঙ্গারা উচ্ছেদ হয়েছে।
আরাকান পরিস্থিতির আরেকটি দিক হলো এটা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে বামারদের দখলকৃত এলাকা। আরাকান কোনভাবেই বামার অঞ্চলের অংশ ছিল না। ফলে সেখানে রাখাইনরা বহু দশক ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। এই লড়াই মোকাবেলার জন্যও আরাকানে বামারদের একাধিপত্য কায়েম প্রয়োজন ছিল। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার পরই এখন তার সেখানে রাখাইনদের সঙ্গেও যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফলে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকট যেমন আরাকান সংকটের একাংশ, তেমনি রোহিঙ্গা সংকটের বাইরেও আরাকানে আরও সংকট রয়েছে। সেই সংকট যেমন রাজনৈতিক-সামরিক, তেমনি অর্থনৈতিকও। বার্মার সিভিল মিলিটারি নীতিনির্ধারকদের সামনে রেখে চীন ও বার্মা আরাকান থেকে অর্থনৈতিক ফায়দা নিতে তৎপর। তারা এক্ষেত্রে অনেকাংশেই সফলও বটে।
আরাকান পরিস্থিতিতে যে নতুন মোড় এসেছে, তা কী বাঙলাদেশে প্রভাব ফেলতে পারে? সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় কী হতে পারে?
আলতাফ পারভেজ: বার্মা ও আরাকান বাংলাদেশের প্রতিবেশী। খুব স্বাভাবিক যে, ওখানকার পরিস্থিতি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তারা এক মিলিয়ন মানুষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা প্রায় কিছু বুঝে ওঠার আগে আগেই এটা ঘটে গেছে। এখন এবং আগামীতে যা ঘটবে তাতেও বাংলাদেশ প্রভাবিত হতেই থাকবে।
মুশকিল হলো বাংলাদেশে বার্মা সম্পর্কে জানা-বোঝার কমতি আছে। বার্মার আর্থ-সামাজিক বিন্যাস সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ তেমন কিছুই জানে না বলেই মনে হয়। নীতিনির্ধারকদের মাঝেও এরকম ঘাটতি আছে বলেই বিভিন্ন সময় প্রতীয়মান হয়েছে।
বার্মায় প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় সশস্ত্র বাহিনী।আবার পুরো সেনাবাহিনীও নয়, দু’একজন জেনারেল। ফলে সেখানে বেসামরিক প্রশাসন বা মন্ত্রীদের সঙ্গে দু’একটি বৈঠক করেই কোন বিষয়ে সফলতা পাওয়া প্রায় দুরূহ।
আরাকানের রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে বাংলাদেশকে গতবছর হতচকিতই মনে হয়েছে। এখন যে আরাকানে রাখাইনদের সঙ্গে বার্মার সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধাবস্থা চলছে সে সম্পর্কেও বাংলাদেশকে তেমন ওয়াকিবহাল মনে হয় না। অথচ এই যুদ্ধে আবার প্রচুর বৌদ্ধ রাখাইন উদ্বাস্তু তৈরি হচ্ছে।
গত বছর প্রচুর রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু চলে আসার পর বাংলাদেশ বার্মা বিষয়ে কিছুটা মনযোগী হলেও এক্ষেত্রে নতুন যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের এদিকে প্রেরণ যেমন বাংলাদেশ বন্ধ করাতে পারেনি তেমনি ফেরত নেয়াতেও পারছে না। সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো পরিবেশ কায়েম হয়নি। আবার রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ প্রত্যাশিত মাত্রায় সক্রিয় হতে পারেনি। ভারত ও চীন বাংলাদেশেরও কথিত বন্ধুরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়ানো যায়নি। এমনকি ‘মুসলমান উম্মাহ’কেও সর্বোচ্চ সহায়ক ভূমিকায় নামানো যায়নি।
তার মানে বাংলাদেশের জন্য করণীয় আসলে দুটি: একটা হলো, বার্মার ভেতরের রাজনৈতিক-সামরিক বিন্যাসটি বোঝা এবং তাতে সম্ভাব্য সহায়ক শক্তি খোঁজা। দ্বিতীয়ত বার্মাকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে আনতে ঢাকার আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী করা।
রোহিঙ্গা সমস্যার তেমন কোন কার্যকরী সমাধান এখনও হয় নাই। এই অবস্থায় আরাকানে যে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা রোহিঙ্গা সমস্যাকে আরো প্রলম্বিত ও দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে ফেলবে কিনা? সেক্ষেত্রে বাঙলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
আলতাফ পারভেজ: রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সহজ নয়। উপরন্তু বার্মার বর্তমান পরিস্থিতিতে তা ক্রমে জটিল হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হলে তাদের সেখানে স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার দিতে হবে। অথচ বামার প্রশাসন স্বীকারই করছে না যে তারা বার্মার নাগরিক। মুসলমান ঘৃণাও বন্ধ হচ্ছে না।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, প্রাক্তন রোহিঙ্গাপ্রধান এলাকাগুলোতে এখন বৌদ্ধপ্রধান আরাকান আর্মির সঙ্গে বার্মার বাহিনীর তুমুল যুদ্ধাবস্থা চলছে। এর কোন সমাধানও বাংলাদেশের হাতে নেই। আবার এর সমাধান আরাকানেও নেই। কারণ আরকান আর্মি হলো বার্মার কাচিন আর্মির বন্ধুসংগঠন। কাচিনদের সঙ্গেও বার্মার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। ফলে জাতীয়ভাবে বার্মায় যদি কাচিন, শ্যান, কারেনসহ সকল জাতিসত্তার মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত না হয় তাহলে আরাকানে আপাতত শান্ত অবস্থা কায়েমের সম্ভাবনা কম। এইরূপ শান্ত অবস্থা সৃষ্টির জন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে যে ছাড় দেয়া দরকার অং সাঙ সুচি তা দিতে পারবেন না, যদি সেনাবাহিনী তাতে সম্মত না হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেখানে সেনাবাহিনীকেই নিতে হবে।
তবে চীন ও ভারত তাদের বিনিয়োগের স্বার্থে আরাকানে যুদ্ধাবস্থা থামাতে সক্রিয়। কিন্তু আরাকান আর্মির সঙ্গে চীনের বৈঠকগুলো কোন সুফল বয়ে আনতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। আবার চীন ও ভারত রোহিঙ্গা বিষয়ে বার্মার সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে এখনও কোন ভূমিকা রাখছে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে এই সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক কোন টেকসই সমাধান চোখে পড়ছে না।
আরাকানের উত্তরে গেরিলা যুদ্ধরত ‘নর্দান এলায়েন্স’-এর আন্দোলন জাতিগত স্বাধিকারের জন্য। রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? তাদের জয়-পরাজয় বা যেকোন সাফল্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে কিনা?
আলতাফ পারভেজ: নর্দান এলায়েন্স হলো আরাকান আর্মি, কাচিন আর্মি, শান আর্মিসহ কয়েকটি গেরিলা সংগঠনের জোট। এই জোটের মধ্যে কেবল আরকান আর্মি হলো আরাকানের। আরাকানে অতীতে অনেক দল স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের জন্য যুদ্ধ করেছে। লড়েছে। আরকান আর্মি এক্ষেত্রে নতুন সংগঠন। আরাকানে রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সামাজিক সম্পর্ক সুখকর নয়। এটা বহুভাবে তিক্ত করা হয়েছে। তবে আরাকান আর্মির প্রধান বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে। তবে আরাকান আর্মিও তাদের রোহিঙ্গা স্বীকার করে না। মনে করে এরা বাংলাভাষী। তবে আরাকান আর্মি মনে করে এরা বাংলাভাষী হলেও এই মানুষদের বার্মায় নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাসের অধিকার রয়েছে। এই মনে করায় আপাতত কিছু যায় আসে না। কারণ আরাকান আর্মি বা নর্দান এলায়েন্স তো সেখানে দেশ চালাবে না। দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি রোহিঙ্গা প্রশ্নে অবস্থান পরিবর্তন না করে তাহলে বাংলাদেশের জন্য কোন সুসংবাদ নেই। তাছাড়া আরকানে আরাকান আর্মি ছাড়া যেসব রাখাইনপ্রধান সংগঠন রয়েছে তাদের মাঝে এখনও রোহিঙ্গাবিদ্বেষ রয়েছে। আরাকান আর্মি এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রমমাত্র।
নর্দান এলায়েন্স ও তাদের আন্দোলনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব কী?
আলতাফ পারভেজ: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শ্যান বা কাচিনদের এলাকায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মূলত উদ্বিগ্ন। ঐসব অঞ্চলের স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসন নিয়ে তেমন কোন অবস্থান নেই কারও। চীন এ বিষয়ে কিছু মধ্যস্থতা করছে। নর্দান এলায়েন্সের যেসব সংগঠন শ্যান স্টেইটের তারা চীনের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। কাচিন এলাকাতেও চীনের বিপুল অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। চীন চাইছে নর্দান এলায়েন্সের সংগঠনগুলো বার্মার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসুক। কিন্তু সমঝোতার জন্য সেনাবাহিনীকে যে ছাড় দেয়া প্রয়োজন সেটা নিশ্চিত করায় চীন এখনও সফল হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় দেশগুলোও বার্মায় সক্রিয়। তবে তারা যতটা চীনকে হটিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করে, ততটা ছোট জাতিগুলোর অধিকার বাড়াতে করে না। তারা নর্দান এলায়েন্সের এলাকায় খুন জখম নিয়েই উৎকণ্ঠিত। তাদের রাজনৈতি ও অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে খুব একটা উৎকণ্ঠিত নয়।
আরাকানের গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে সরকারের কোনরকম সমঝোতার সম্ভাবনা আছে কিনা? সেটা রোহিঙ্গাদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে কিনা?
আলতাফ পারভেজ: সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়তো হতে পারে। নর্দান এলায়েন্সকে বার্মার সেনাবাহিনী চার মাসের যুদ্ধবিরতিতে আহ্বানও করেছে। তবে তাতে আরাকানে যুদ্ধাবস্থা থামেনি। বরং এখানে তা আরও তীব্র হচ্ছে। বার্মার বাহিনী যেকোন মূল্যে আরাকানকে শান্ত রাখতে চাইবে। এর এক বড় কারণ চীন ও ভারতের বিনিয়োগ। সেটা আগেই বলা হয়েছে।
সম্প্রতি বার্মা সরকার রাখাইন সশস্ত্র গেরিলাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংগঠন ‘আরসা’র যোগসূত্র আছে বলেও প্রচার চালাচ্ছে। তার মানে এখানে রাখাইনদেরও আরও নিপীড়িত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তবে আরাকানে যুদ্ধবিরতি হলেও তাতে রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক কোন লাভ আছে বলে মনে হয় না। কারণ রোহিঙ্গা সমস্যাটা অনেক পৃথক চরিত্রের। তার সমাধানও অনেক পৃথক করণীয় দাবি করছে।
অনেকেই মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সাথে ইসলামপ্রশ্ন জড়িত আছে। এদেশের ইসলামপন্থীরা রোহিঙ্গা সঙ্কটে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে মানবাধিকারকর্মী ও ইসলামপন্থীদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
আলতাফ পারভেজ: রোহিঙ্গারা মুসলমান। কিন্তু এই সংকট তো ইসলামসংশ্লিষ্ট কোন সমস্যা না। রোহিঙ্গারা চাইছে নাগরিক অধিকার। স্বাভাবিক মানবাধিকার। এখানে তো ধর্মের কোন বিষয় যুক্ত হয়নি। বহুকাল যাবত তারা ওখানে আছে। এখন তাদের গণহত্যা চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর প্রতিকার হতে হবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনে যা সমাধান আরাকানেও তাই হতে হবে। রোহিঙ্গারা চাইছে শান্তিতে বসবাসের অধিকার। এ বিষয়ে অন্যান্য শান্তিপ্রিয়, মানবিক মানুষদের মতোই বাংলাদেশের মানুষদেরও সমর্থন থাকবে এটা অস্বাভাবিক নয়।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর জনগণ তাদের সাহায্য করেছে। সেক্ষেত্রে তারা মুসলমান বলে মানুষ উদারভাবেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ত্রাণ দিয়েছে। এর বাইরে এখানে বাংলাদেশের মুসলমানদের আর যা করার আছে তা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ফরিয়াদ জানানো এদের ফেরত নেয়ার জন্য। বার্মার উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য। সেক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশের কোন সংগঠনকে তেমন সক্রিয় দেখা যায় না।