সেমিফাইনাল ও ফাইনালের আগেই বাংলাদেশিদের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় রাত জেগে রাস্তা আটকিয়ে বড় পর্দায় খেলা দেখার আগ্রহে ভাটা পড়েছে ইতিমধ্যে। স্পষ্ট যে, এই দর্শকদের আগ্রহে ফুটবলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু যুক্ত ছিল, যা ইভেন্টটি থেকে হারিয়ে গেছে।
রাশিয়ার জন্যও এটা কেবল ফুটবলের অনুষ্ঠান ছিল না। অন্তত দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য। ইভেন্টটি কূটনৈতিক অঙ্গনে তার জন্য চমৎকার সফলতা এনে দিয়েছে। সে কারণেই হয়তো বলা যায়, প্রায় ৭৬ হাজার বর্গফুটের মাঠের বাইরে ২০১৮-এর বিশ্বকাপের মূল চ্যাম্পিয়ন পুতিন। তবে এ জন্য দেশটির খরচ হয়েছে ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং তার ৭০ শতাংশ হিস্যাই ছিল দেশটির করদাতাদের।
আগামী ১৫ জুলাই ফিফা বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয়ে যাবে। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন হেলসিংকিতে। কৌতুকের ছলে কেউ কেউ বলছেন, এবারের বিশ্বকাপের প্রকৃত চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে প্রথম বৈঠকটি হচ্ছে ট্রাম্পের।
দুই. বিশ্বকাপের আগের দৃশ্যে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে রাশিয়া ছিল প্রধান এক খলনায়ক। মার্চে প্রায় ২০টি পশ্চিমা দেশ একযোগে রাশিয়ার প্রায় ১০০ কূটনীতিবিদকে বহিস্কার করেছিল। সে সময় শুধু যুক্তরাষ্ট্রই ৬০ রুশ কূটনীতিবিদকে তাদের দেশ ছাড়তে বলে। ইতিহাসে কোনো দেশের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক যুদ্ধের বড় এক দৃষ্টান্ত ছিল এটা। সেই সময় গালমন্দ করতে গিয়ে ব্রিটেনের সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন রাশিয়া বিশ্বকাপকে তুলনা করেছিলেন নাজিদের ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক আসরের সঙ্গে। এটা ছিল বিশ্বকাপ বয়কটের মতো এক বার্তা। ব্রিটেন তার ফুটবলপ্রেমীদের রাশিয়া ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা দেখামাত্র দৃশ্যপট আমূল পাল্টে যায়। ব্রিটেনের নাগরিকরা দলে দলে বিমান চার্টার করে হলেও খেলা দেখতে গেছে। কোয়ার্টার ফাইনালের শেষ ম্যাচে মস্কো থেকে সামারা পর্যন্ত ব্রিটেনের দর্শকদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে রাশিয়াকে। প্রচারমাধ্যমে এসব খবর ছিল ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের জন্য যন্ত্রণাতুল্য।
তিন. বিশ্বকাপ মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় রাশিয়ার ইমেজ বিশেষভাবে হৃদ্য করেছে। সৌদি যুবরাজ সালমান কিংবা জাপানের রাজকুমারী তাকামাদোর স্টেডিয়ামে উপস্থিতি শুধু নিজ নিজ দেশের খেলোয়াড়দেরই উদ্দীপ্ত করেনি; পুতিনের ইমেজ বৃদ্ধিতেও তা অবদান রেখেছে। কারণ উভয় দেশের সঙ্গে রাশিয়ার পুরনো বৈরিতা রয়েছে।
অনেকেই বলছেন এখন, এবারের বিশ্বকাপের প্রধান অর্জন দুটি। প্রথমত, র্যাঙ্কের নিচের দিকের দলগুলোর ওপরে উঠে আসা এবং দ্বিতীয়ত, পুতিনের র্যাঙ্কিং বেড়ে যাওয়া।
বিশ্বকাপ চলাকালেই রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয় মস্কোতে। অতীতে উত্তর কোরিয়া ছিল রাশিয়ার মিত্র, আর দক্ষিণের ওপর ছিল ওয়াশিংটনের একক নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু ১৯ বছর পর দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো প্রেসিডেন্ট মস্কো এলেন এবার। উপরন্তু পুতিন ও মুন উভয় দেশকে ‘কৌশলগত অংশীদার’ বলে ঘোষণা দিলেন। এসব দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়।
চার. বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা বড় বড় ইভেন্ট আয়োজন পছন্দ করে। কারণ এতে শাসন দীর্ঘায়িত করা যায়। পুতিন ইতিমধ্যে কয়েক দফায় ১৪ বছর রাশিয়া শাসন করেছেন। খুব শিগগির তাকে যেতে হবে- এমন কোনো লক্ষণও নেই আপাতত। বরং বিশ্বকাপের আসর যত গড়িয়েছে, তার আন্তর্জাতিক সমালোচকদের ঝুড়িতে একের পর এক গোল জমা হয়েছে।
প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ‘কূটনীতিক বয়কটে’ যোগ দিলেও দল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠামাত্র সুইডেন বয়কট থেকে ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন বলেন, ‘ফুটবল এমন কিছু, যা ঐক্যের কথা বলে!’ উরুগুয়েকে হারানোর পর স্বদেশি ফুটবলারদের স্টেডিয়াম থেকে উৎসাহ দিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রনও ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন রাশিয়া।
বস্তুত ইভেন্টে ইউরোপীয়রা যত ভালো করছিল, পুতিনের জন্য ততই লাভ হচ্ছিল। হঠাৎ আবার ফুটবল ইউরোপে দেশে দেশে ‘জাতীয় গর্বে’র ধনে পরিণত হয়েছে। ফলে দলে দলে ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ মার্চ-এপ্রিলের বয়কট ফেলে রেখে রাশিয়ায় এখন। কোয়ার্টার ফাইনাল-সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের জন্য স্টেডিয়ামে বসে স্বদেশের খেলা দেখার ছবি প্রচার করা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রয়োজনেই জরুরি। ইউরোপজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার মাঝে এ এক উত্তেজক জ্বালানিও বটে।
পাঁচ. পুতিনও পরিস্থিতিকে দ্রুত কাজে লাগাতে কার্পণ্য করছেন না। পশ্চিমের প্রচারমাধ্যমের চাপ কমে আসার পটভূমিতেই বিশ্বকাপ চলাকালে ঘোষণা করা হয়েছে, দেশটিতে পেনশনের বয়স ৫৫ থেকে ৬৩ করা হচ্ছে। এতে পুতিনের জন্য বর্তমান প্রশাসনের সমর্থন বাড়লেও চাকরিপ্রত্যাশীদের তা হতাশ করেছে। কিন্তু বিশ্বকাপের উত্তেজনার মাঝে বিক্ষোভের আশঙ্কা ক্ষীণ। বরং রুশরা এ মুহূর্তে ব্যাপকভাবে খুশি ‘নিজ দেশ’কে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত আসতে দেখে। বিশ্বকাপের আগে যে দলের র্যাঙ্কিং ছিল ৭০!
হয়তো উত্তেজনা কিছুটা থিতিয়ে এলেই জানা যাবে, ছয় লাখের মতো বিদেশির আগমন-নির্গমনের বাইরে রুশ দেশের বিশ্বকাপ আয়োজক ১১টি শহর কী পেল। যদিও পুতিন বলছে, বিশ্বকাপ তাদের জিডিপিতে ২০১৩ থেকে পরবর্তী ১০ বছর ৩১ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করবে এবং দুই লাখ ২০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু আপাতত এমন প্রশ্ন করার কেউ নেই যে, চার বছর আগে ৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আয়োজিত শীতকালীন অলিম্পিকের কর্মসংস্থানগুলো কোথায় গেল।
বস্তুত ফুটবল উন্মাদনা অনেকখানি মাদকের মতোই। মানুষকে অনেক কিছু ভুলিয়ে রাখতে পারে। বাংলাদেশে যে ক্যাম্পাসে সম্প্রতি ছাত্রদের হাতুড়ি দিয়ে হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও বর্বরতা ফুটবল উন্মাদনার রেশ ম্লান করতে পারেনি। তেমনি হয়তো এ বিশ্বকাপের পর ইউক্রেন সীমান্তে ২০১৪ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ার বিমানটির কথাও ভুলে যাবে আন্তর্জাতিক পরিসরের সবাই। যে ঘটনায় মারা গিয়েছিল তিনশ’ নিরপরাধ মানুষ এবং যার জন্য অনেক নিরপেক্ষ তদন্তকারীই রাশিয়াকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু নিহতদের স্বজনদের কণ্ঠস্বর এবার দুর্বল হওয়ার পালা।
ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরাও হয়তো জীবনযুদ্ধে আবার ব্যস্ত হয়ে খেয়াল করতে ভুলে যাবেন, বিশ্বকাপ চলাকালে কোটা সংস্কারের মতো সাধারণ জাতীয় স্বার্থে কথা বলতে গিয়ে দেশজুড়ে অনেক তরুণ-তরুণী বর্বরতম কায়দায় অত্যাচারিত হয়ে সবার মনোযোগের বাইরেই ধুঁকছে এখন।
বিশ্বজুড়ে আনন্দ ও অত্যাচারী বাস্তবতার এই আড়ালটুকুই বিশ্বকাপের প্রকৃত বিজয়ী অবশেষ। যা নিয়ে উল্লাস করা যায় না, কিন্তু তাকে নিয়ে ভাবতে হয় বৈ কি। অন্তত ১৫ জুলাইয়ের পর তাই হোক।