মমতার ‘বিজয়’ যে ছবি মনে করিয়ে দেয়

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের জন্য বাসি খবর। কিন্তু যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতি করতে ও বুঝতে চান তাদের জন্য এ নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বোঝাপড়া জরুরিই।
বিজেপি-আরএসএস পরিবারের ‘ভারত বিজয়’ কেন পশ্চিমবঙ্গে এসে থেমে গেল এবং কেন মহারাষ্ট্রের মতো হিন্দুত্ববাদের ঘাঁটিতে লালপতাকা নিয়ে দুনিয়াব্যাপী নজরকাড়া বিশাল লংমার্চ (৬-১২ মার্চ ২০১৮) করে কৃষাণেরা দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে পারে; কিন্তু গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ভোটের আগে প্রার্থী সঙ্কটে ভোগে, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে ধাঁধাঁই বটে।

কলকাতার বন্ধুদের কাছে যখন ‘তৃণমূল’-এর ভোট অভ্যুত্থানের রহস্য জানতে চেয়েছি, তারা তখন ‘দলিত-মুসলিম ঐক্য’-এর কথা বলেছে। ভারতের রাজনীতির ভাষায় এটাকে বলা হচ্ছে ‘বহুজন’বাদ। এ রাজনীতি মুখ্যত সব সংখ্যালঘুকে ঘৃণা ও বিভেদের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ‘অন্তর্ভুক্তকরণ’-এর কথা বলে। বহুজনবাদী সেই রাজনীতির সূত্রেই ঐতিহাসিক ছবিটির কথা মনে পড়ল।

মওলানা হসরত মোহানী এবং ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের ছবিটি ১৯৪৯-এ তোলা বলে জানা যায়। বল্লভ ভাই প্যাটেলকে নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ছবিটি তোলা হয়েছিল। প্যাটেল, আম্বেদকর, মোহানী প্রমুখ কেবল ব্যক্তি নন- উপমহাদেশে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধারার প্রতীকও বটে। ফলে বল্লভ ভাইয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে শ্রোতা-দর্শকদের থেকে খানিক দূরে বসে আম্বেদকর আর মোহানী যখন আলাপচারিতায় লিপ্ত হন, তারও প্রতীকী অনেক তাৎপর্য থাকে বৈকি। একই ধারাবাহিকতা থেকেই এ ছবি ঊনসত্তর বছর পরও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফল দেখে পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। ইতিহাস ও রাজনীতি কতভাবেই না নিজেদের আন্তঃসম্পর্কের কথা জানায়, কালে কালে!

দুই.
উপমহাদেশে দলিত আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বি আর আম্বেদকর বাংলাদেশেও খানিকটা পরিচিত। সেই তুলনায় মওলানা মোহানীকে আমরা কমই জানি। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে দলিত-মুসলিম ঐক্যের অন্যতম যুগলবন্দী বলা যায় আম্বেদকর-মোহানীকে। কেবল রাজনীতিই নয়, লিখেছেনও তারা প্রচুর। আম্বেদকর মূলত রাজনৈতিক গদ্য; মোহানী মূলত গজল। শ্রী কৃষ্ণকে নিয়েও অনেক ভজন লিখেছেন তিনি। বস্তুত ‘হসরত মোহানী’ পরিচয়ের আড়ালে তার পরিবারপ্রদত্ত নামটিও হারিয়ে গেছে- যা ছিল, সৈয়দ ফজল-উল-হাসান। এক কালের বিখ্যাত সংগঠন ‘প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য ছিলেন তিনি।

‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) স্লোগানের প্রবক্তা ছিলেন হসরত মোহানী- এটা উপমহাদেশের ইতিহাসে তার বিশেষ খ্যাতির দিক। ফাঁসির মঞ্চে পাঞ্জাবের শিখ স্বাধীনতাসংগ্রামী ভগত সিং এই স্লোগানকে অমরত্ব দিয়েছিলেন, সেও আমাদের জানা। তবে ভারতজুড়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যাপকতা পাওয়ার প্রায় দুই দশক আগে সে-ই ১৯২১-এ ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলার ভিন্ন রণনৈতিক তাৎপর্যও আছে। বস্তুত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ, উভয় দলেই স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসপন্থীদের কোণঠাসা করতে মওলানা মোহানীর ওই স্লোগান জাদুকরী ভূমিকা রেখেছিল। দ্রুতই সেøাগানটি ভারতীয় নি¤œবর্গের কাছে ‘স্বাধীনতা’র পাশাপাশি বৃহত্তর ‘মুক্তি’র আকাক্সক্ষাকে সামনে নিয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ‘স্বাধীনতা’ এলেও দলিত ও মুসলমানদের জন্য ভারতবর্ষে সামাজিক শোষণ থেকে ‘মুক্তি’র প্রশ্নটি যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, সে কথাও যেন আজ থেকে ৯৭ বছর আগেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন মোহানী তার ওই অসামান্য কাব্যময় দু’টি শব্দে- ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।

জিন্নাহ-গান্ধী-প্যাটেলের সাথে তুলনা করলে আজকের দিনে মওলানা মোহানী এবং বি আর আম্বেদকরের একটা বড় শক্তির দিক হলো, তারা কোনো একক দলের পুঁজি-পাট্টা আকারে নেই আর; বরং তাদের চিন্তা স্বতন্ত্র এক মুক্তিতত্ত্ব আকারে উপমহাদেশজুড়ে সবার সামনে হাজির আছে। ওই তত্ত্বের আবেদন যে আজো জারি আছে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে, মমতার পাশে দলিত-মুসলিম-ট্রাইবাল ঐক্যের ঘটনা সেই বার্তাই দিচ্ছে।

জানেন অনেকে, তবু বলে রাখছি, ৩০ শতাংশ মুসলমান, ২৬ শতাংশ দলিত এবং ৫ শতাংশ ‘ট্রাইবাল’ মিলে পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্গের যে সমীকরণ মমতাকে এখন সুরক্ষা দিচ্ছে, এর জরুরি রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা সূত্রবদ্ধ করেছিলেন আম্বেদকর, যোগেন মণ্ডল, মওলানা মোহানী প্রমুখ সত্তর বছর আগেই। ১৯৮০ থেকে পরের দুই দশক একই ‘মুক্তিতত্ত্ব’-এর কথা বলতেন উত্তর প্রদেশ ও দিল্লিতে কানশি রাম। এলিট বর্ণরাজনীতির বিরুদ্ধে এসব ব্যক্তি যে ‘বহুজন’বাদিতার কথা বলেছিলেন, সেই রাজনৈতিক প্রকৌশলবিদ্যা ছাড়া হয়তো বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার ডাইনেস্টিকেন্দ্রিক ভরকেন্দ্রগুলোও কোনোদিনই ভাঙা যাবে না।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আকারে মমতা ব্যানার্জিকে জীবনের শুরুতে কলকাতার বাঘা-বাঘা বুদ্ধিজীবীরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন; কিন্তু ইতিহাসের ছাইভস্ম থেকে যখন তিনি মোহানী-আম্বেদকর-যোগেন মণ্ডলদের অব্যবহৃত সংখ্যাতত্ত্বটি শানান ছুরির মতো হাতে তুলে নিলেন, তখন বাম বুদ্ধিজীবীতা তার দাঁড়ানোর পাটাতন হারিয়ে ফেলল।

সাঁওতাল, রাজবংশী, মুসলমান ও দলিতদের বহুকাল যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল সমাজ নিজেদের ‘ভোটব্যাংক’ ভেবেছেন। কিন্তু এই ভোটব্যাংকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য করেছেন তারা সামান্যই। সেই বিশ্বাসভঙ্গ এখন আবার সত্তর বছর পুরনো মোহানী-আম্বেদকরদের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা হাজির করছে নতুন করে।

তিন.
১৮৭৮ সালে উত্তর প্রদেশে জন্ম নেয়া হসরত মোহানী নিজে কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ব্রিটিশবিরোধী লেখনীর জন্য ১৯০৮-এ প্রথম সি-ক্লাস প্রিজনার (প্রতিদিন যাদের কারাগারে এক মণ শস্যদানা ভাঙতে হতো) হিসেবে কারাভোগ করেন। ১৯২২ থেকে ১৯২৪-এ আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র ধারণা প্রচারের অপরাধে। গান্ধী যখন নিছক ‘ডমিনিয়ন’ মর্যাদার জন্য লড়ছিলেন (অন্তত ১৯২৯ পর্যন্ত) তখন ‘স্বরাজ’ বা ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র সমর্থক হওয়ার কারণেই বাল গঙ্গাধর তিলককে খুব পছন্দ করতেন হসরত মোহানী।

১৯২৫-এ কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী সমাবেশটিতে আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মওলানা মোহানী। পরিণত বয়সে প্রায় বছরই হজে যেতেন তিনি; কিন্তু মনে হয় না, উপমহাদেশের কোনো কমিউনিস্ট পার্টি বা ইসলামপন্থী দল এ মওলানাকে এখন আর তাদের নিজস্ব একজন হিসেবে স্মরণ করে। তবে সৌভাগ্য তার, করাচি থেকে কলকাতা পর্যন্ত অনেকেই অন্তত মে মাস এলে মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে ভাবতে বসে। তার গজল ও ভজন শোনে। এ ধারাবাহিকতায় এবার বাড়তি সংযোজন ছিল, কলকাতায় এবার মে মাসে অনেক বুদ্ধিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহানী ও আম্বেদকরের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেই তৃণমূলের বিজয়কে বোঝার চেষ্টা করছেন।
কার্যত, বিজেপি-আরএসএস পরিবারের বর্ণবাদী রাজনীতির বিপরীতে, ডাইনেস্টিকেন্দ্রিক রাজনীতির চলতি ছদ্ম‘যুদ্ধ’ সামাল দিতে দলিত-মুসলমান-খ্রিষ্টান-শিখ-ট্রাইবাল ঐক্যের রাজনীতি ছাড়া উপমহাদেশের সামনে আর বিকল্পই বা কী আছে? হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মমতা এবং উত্তর প্রদেশে কানশি রামের শিষ্যা মায়াবতী, সে ক্ষেত্রে ভারতকে অন্তত পথ দেখাবেন।

*প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায়, ৩০ মে ২০১৮

শেয়ার করুন: