মানুষ যে কারণে মানুষের পাশে দাঁড়ায়

বিশ্বজুড়ে এখন দুটো দৃশ্য। একটা হলো ভাইরাসের তোপের মুখে মানুষ নিজেদের রক্ষায় মরিয়া সংগ্রামে লিপ্ত। এই সংগ্রামের শ্রেণীভেদ আছে। ধনীরা বড় বড় দোকান থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় বিপুল জিনিস কিনে যার যার ঘরে থিতু হয়ে আছে। আর গরীবরা রুটি-রুজি হারিয়ে দিশেহারা,বিপর্যস্ত, ক্ষুব্ধ। এর বাইরে আরেকটি বড় দৃশ্যও দেখছি সবাই। মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষ।

বিশ্বের সকল দেশে লাখ লাখ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে করোনা-দুর্যোগে কোন না কোন প্রতিকারমূলক কাজে নেমেছে এমুহূর্তে। কেউ কেউ একে ‘ত্রাণ’ বলছেন। এভাবে বলাটা এক ধরনের দৈন্যতার প্রকাশ। ‘ত্রাণ’ একটা ‘টপ-ডাউন’ মনোভাবের ফল। এর পেছনে ‘সিস্টেম’কে রক্ষার পরোক্ষ তাগিদ থাকে। বিপরীতে ‘পারস্পরিক সহায়তা’ একটা আনুভূমিক প্রক্রিয়া। মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে সেখানে। কার্যত এখন সেটাই ঘটছে।

হাজার হাজার যেসব মানুষ এখন বিশ্বজুড়ে করোনা-দুর্যোগে পারস্পরিক সহায়তায় নেমেছে তাদের অধিকাংশেরই ত্রাণধর্মী মনোভাব নেই। এদের মাঝে রয়েছে তীব্র সংহতির তাগিদ।

এমন দৃশ্য বিরল নয় যে,কিছু কিছু ব্যাক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্যকে সংহত ও জাহির করতে দুর্যোগ এলেই ‘ত্রাণ’ধর্মী কাজে নামে। এরা সবসময়ই দাতা-গ্রহীতা একটা সম্পর্ক জারি রাখতে চায়। এরা সচরাচর ‘ক্ষমতা’র নিকটবর্তী চরিত্র হয়ে থাকে। সমাজে ক্ষুদ্র একটা ধারা হিসেবেই এরা উপস্থিত থাকে। তবে এদের তৎপরতাও সমাজের গভীরে থাকা পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতার কথাই জানায়।

রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে সহায়তা

সমাজে কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা যে এগিয়ে যায়– এটা সভ্যতার সমান পুরানো ঐতিহ্য। পারস্পরিক সহায়তার ওপর ভর করেও মানুষ এগিয়েছে বরাবর। এই শক্তি মানুষের অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান হিসেবে উপস্থিত ছিল।

‘পারস্পরিক সহায়তা’র ধারণায় ভিন্নমতও আছে অনেকের। একদল মনে করে, করোনা মহাসংকট সামাল দেয়ার দায়িত্ব ‘রাষ্ট্র’-এর। পরিবর্তনবাদী মানুষদের কাজ নয় কেবল সহযোগিতা-সংস্কৃতিতে আটকে থাকা। এটা অরাজনৈতিক কাজ। বরং রাজনৈতিক কর্মীদের জোর দেয়া উচিত দুর্যোগকবলিত মানুষের দায়িত্ব নিতে ‘রাষ্ট্র’কে বাধ্য করার ওপর।

অবশ্যই মহাদুর্যোগে মহাকর্তৃত্বশালী রাষ্ট্রেরই মানুষকে রক্ষার মূল কাজ। এটা করতে যেয়ে রাষ্ট্র ক্রমে আরও দানবীয় হয় এবং পারস্পরিক সহায়তার মানবিক ঐতিহ্যকে আরও ধ্বংস করে। আর ‘পারস্পরিক সহায়তা’ একই কাজ করতে যেয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের জনবিচ্ছিন্ন অতিকেন্দ্রীভূত চরিত্রের বর্তমান কর্তৃত্ববাদী ‘সিস্টেম’ সারানোর পদ্ধতিগত পথ দেখায়। এই অর্থে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ্ধতিও বটে।

মানুষের প্রধান বুদ্ধিদৃপ্ত ঐতিহ্য অপরকে সহায়তা করা

পুরানো উদাহরণগুলো বাদ দিয়ে আমরা করোনাকালে বাংলাদেশের দিকেই কেবল মনোযোগ দিতে পারি। চলতি সময়ের পারস্পরিক সহায়তার দৃষ্টান্তগুলো দেখলে সেখানে পাবো স্বেচ্ছাসেবায় প্রণোদিত বিপুল মানুষ। পরস্পরকে সহায়তার মনোভাব থেকে এই মানুষরা বহু বিচিত্র পথে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমে এই সংখ্যা বাড়ছে। লক-ডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা না থাকলে এই সংখ্যা যে আরো কয়েকগুণ বাড়তো– তাতে সন্দেহ নেই। এরকম মনোভাব মানুষের প্রাচীন বৈশিষ্ট্য।

প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সমাজের স্বার্থে সঠিক ভূমিকায় নামাই ছিল মানুষের প্রধানতম বুদ্ধিদৃপ্ত অভ্যাস ও সবচেয়ে পুরানো রাজনীতি। মানুষ কেবল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ তাড়িত হয়ে পরস্পরের মাঝে মারামারি-যুদ্ধ-বিগ্রহ করে এগোয়নি। সংঘাতের চেয়ে সংহতিই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে অধিক। পরস্পরের প্রয়োজনে মানব গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মাঝে হাজার হাজার বছর ধরে শ্রম ও সম্পদের বিনিময় করেছে অকাতরে– কোন ধরনের স্বীকৃতি ও প্রশংসার অপেক্ষা না করেই। ‘রাষ্ট্র’ নয়, মানুষের এসব পারস্পরিক সহায়তাই তার অস্তিত্বের সংগ্রামকে বেশি এগিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন সংকটকালে। এর জন্য কোন ‘কেন্দ্রীভূত’ কর্তৃত্বের চাপ দরকার হয়নি। যখন ‘কর্তৃত্ব’কে দুর্বল দেখা গেছে তখনি মানুষ মানুষকে রক্ষায় বেশি ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুগত সম্পদের অধিকতর বিলি-বন্টনের দায়িত্ব হাতে নিতে চাওয়া মানুষের সবচেয়ে পুরানো মানবিক আকাঙ্খা।

ভয়ঙ্কর কোভিড-১৯ এর মুখে দাঁড়িয়েও মানুষ তার সেই পুরানো রাজনৈতিক অস্ত্রই ব্যবহার করতে চাইছে এখন পুনঃপুন। এটা অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। মানুষের পারস্পরিক সহায়তার এই চেষ্টাগুলো ‘স্বতঃস্ফূর্ত’। কিন্তু এগুলো  তার ঐতিহাসিক জীববিদ্যারই পরম্পরা মাত্র। একই প্রবণতা দেখবো আমরা প্রাণীজগতেও। প্রতিনিয়তই তারা অস্তিত্বের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বা দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পরস্পরের সহায়তার ওপর ভর করে। তবে ইতিহাস লিখিয়েদের সংকট হলো তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রাণীজগতের সংঘাত ও সংঘর্ষকে যেভাবে নথিবদ্ধ করছেন– পারস্পরিক সহায়তার অবদানকে ততটা করেন না।

স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে থাকে মুনাফাহীন মনোভাব

করোনাকালে যাদের আমরা পারস্পরিক সহায়তার কাজে লিপ্ত দেখছি– তাঁদের বড় অংশই স্বউদ্যোগে এই কাজে নেমেছে। দুর্যোগকবলিত মানুষদের সাহায্যের কাজে তাঁদের মাঝে আমরা দেখবো মুনাফাহীন একটা মনোভাব। তাঁরা এই কাজে পরস্পরকে সমান মর্যাদায় দেখছে। প্রতিদিনকার কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হচ্ছে অংশগ্রহণমূলকভাবে। একটা সমতার মনোভাব কাজ করে স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে। এরূপ গ্রুপগুলোতে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের স্তরায়িত কাঠামো বা পরম্পরা থাকে খুব কম। থাকে না আমলাতান্ত্রিক মনোভাবও। মুখ্যত সদস্যনির্ভর কাঠামো এগুলো। দ্রুত ‘স্থানীয় জ্ঞান ও সম্পদ ব্যবহার করে’ ‘কিছু করা’র সমবায়মূলক মনোভাবই প্রধান প্রবণতা হিসেবে দেখা যায় এসব সাংগঠনিক তৎপরতায়। এরা তাদের কোন ‘উদ্যোগ’কে সচরাচর ‘প্রাইভেটাইজ’ করতে চায় না। সংহতির মনোভাব এত তীব্র যে, মানুষ অন-লাইনে পরস্পরকে না দেখেও ‘পারস্পরিক সহায়তা’র আহ্বানে অকাতরে সাড়া দিচ্ছে।

নিকট অতীতে দেখা গেছে, অনেক দেশে, অনেক দুর্যোগে– গতানুগতিক বাজার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় পারস্পরিক সহায়তা হিসেবে ‘সমাজ’ যার যার উৎপাদিত পণ্য বিনিময়েরও ব্যবস্থা করে নিয়েছে। যে সব্জি উৎপাদন করে সে তার পণ্য দুধ কিংবা মাংস কিংবা অন্য কিছু উৎপাদনকারীর সঙ্গে বিনিময় করে সংকট এড়িয়ে নতুন এক সামাজিক সম্পর্ক ও বিনিময় ব্যবস্থার পত্তন করে নেয়। যদিও এসব তৎপরতার কাঠামোসমূহের অনেকগুলোই ঠিক প্রথাগত কোন ‘সংগঠন’ নয় – কিন্তু এর মাঝেই লুকিয়ে থাকে খুবই কেজো এক পজিটিভ সাংগঠনিক মডেল।

সন্দেহ নেই যে, বিশ্ব ঐতিহাসিকভাবে শুধু পারস্পরিক সহায়তার ‘মডেল’ই এগোয়নি। নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাত-শ্রেণী সংগ্রামও সেখানে প্রবলভাবে কাজ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক সহায়তার মডেলকে বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক পরিসরে অনেকখানি পুনঃস্থাপিত করেছে প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। যার বড় এক ফল সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক যুদ্ধ-বিগ্রহ-সহিংসতা এবং ধর্ম-বর্ণ-জাতি ঘৃণা। ফ্যাসিবাদও এরই অনিবার্য ফল।

যখন আমরা প্রতিযোগিতামূলক সমাজে এলাম

এখনকার বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটি মূলত প্রতিযোগিতার মন্ত্রকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এর প্রধান বার্তা হলো কেউ ‘লাভবান’ হবে– কেউ ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হবে। এই পদ্ধতির ভূমিকা-উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক আছে। প্রতিযোগিতা– না সহায়তার মাধ্যমে মানুষ অধিক সম্পদ সৃষ্টি করতে সক্ষম সেটাও বিশদ বিশ্লেষণ দাবি করে। এ লেখায় সেসব আলোকপাত করা হচ্ছে না আপাতত। তবে প্রতিযোগিতামূলক-মডেলের বড় সফলতা হলো বিশ্বজুড়ে পারস্পরিক সহায়তার ঐতিহাসিক অর্জনগুলোকে নবীনদের থেকে বেশ আড়াল করতে পেরেছে তা। প্রতিযোগিতার ধারণা সম্পদের বন্টনধর্মী অসমতাকে পরোক্ষে ন্যায্যতা দেয়।

‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’র ধারণা ও ‘রাষ্ট্র’ চলে আসার পর মানুষের পারস্পরিক সহায়তার প্রবণতাকে খাটো করা হয়, এর অর্জন ও ক্ষমতাকে আড়াল করা হতে থাকে – এমনকি একে দমনের চেষ্টা চালানো হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দেখবো,যে রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদী হয়েছে সেখানে ইউনিয়নধর্মী কাজ তত নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

পারস্পরিক সহায়তার ধারণা অন্তর্গতভাবেই কেন্দ্রীভূত-কর্তৃত্ববাদী-একক ক্ষমতার ধারণাকে নাকচ করে। যে কারণে বরাবরই পারস্পরিক-সহায়তা-সংস্কৃতির প্রধান প্রতিপক্ষ ‘রাষ্ট্র’ ও এর অধিপতিশ্রেণী। তাদের হয়ে কাজ করে অনেক প্রচার মাধ্যম ও বিদ্যাপীঠ। প্রতিযোগিতার বদলে সহায়তার পথে এগোলে মানুষ যে আরও নিরাপদ ও সবল একটা বিশ্ব গঠন করতে পারে সেটার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত তরুণ-তরুণীদের ‘প্রতিযোগিতায় জেতা’র জন্য আহ্বান জানানো হয়। দশকের পর দশক এভাবে প্রচার ও উস্কানির কারণে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থবাদী প্রবণতা বড় হয়ে ওঠে। তারা অপরকে ‘হারিয়ে’ কেবল নিজে ‘লাভবান’ হতে চায়।

কিন্তু পারস্পরিক সহায়তার বিষয়টি তারপরও মানুষের প্রবণতার অভ্যন্তরে রয়ে যায়। কারণ তার প্রবণতার স্বাভাবিক অভিমুখ পারস্পরিক সহায়তা। করোনা দুর্যোগকালে আমরা তারই জয়জয়কার দেখছি। অতীতের সকল দুর্যোগেও তাই ঘটেছে। মানুষের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে বিকৃত করার জন্য বহু চেষ্টাও জারি থাকে সমাজে। এমনকি ‘ত্রান’-মডেলও দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে মানুষের পারস্পরিক সক্ষমতার সামর্থ্যকে খাটো করে।

তবে শেষমেষ যে নতুন প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ হাজির হয় তাহলো,পরস্পরকে সহায়তার চলতি মানব-প্রবণতা ও তার বিচিত্র সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাগুলোকে কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়? দুর্যোগকালে সংহতির সাম্প্রতিক বিপুল অর্জনকে কীভাবে ভবিষ্যতের পুনর্গঠনে মূলধারা করা যায়? যে বিপুল একাত্মতা আজ আমরা দেখছি স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে– তাকে কীভাবে অব্যাহত রাখা যায়? নিঃসন্দেহে এসব চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক। এই চ্যালেঞ্জে পরাজিত হলেই কেবল বিকল্প হিসেবে জায়গা করে নেয় কর্তৃত্ববাদী,প্রতিযোগিতামূলক এবং কেন্দ্রীভূত ‘রাজনীতি’। আর এই রাজনীতি যখনি কর্তৃত্ব নেয়– তখনি আমরা দেখি পরস্পরকে সহায়তার শক্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে।

*প্রথম প্রকাশিত হয় ‘অরাজ’ নামক জার্নালে, ২০২০ সালে

শেয়ার করুন: