এনআরসি প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের ব্যাত্যয়
রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ২০১৪ সালে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, পরবর্তী এক দশকের মধ্যে বিশ্ব থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকতা’র বিষয়টি ইতিহাসের বিষয় করে দেয়া যাবে। কিন্তু সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু হওয়া মাত্র অসমে চল্লিশ লাখ মানুষকে ‘নাগরিকত্ব হারা’র ঘটনাটি ঘটে। স্পষ্টত এটা ছিল একটা বৈশ্বিক পশ্চাদ্ধাবন। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার সংগঠকরা যখন সকল মানুষের জন্য জাতীয়তার অধিকার নিশ্চিত করতে তৎপর— ঠিক তখনই এক ঘটনাতেই চল্লিশ লাখ মানুষকে জাতীয়তাহীন করে ফেলা হল।
অসমের এই ঘটনাকে বহুভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ ও প্রথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে দেখা যায়। ১৯৪৮-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী “প্রত্যেক মানুষের একটা জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকে যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।” বিশ্বের প্রত্যেক দেশে নিজস্ব আইনের আলোকেই মানবাধিকারের ঐ সনদের প্রতি একরূপ দায়বদ্ধতা রয়েছে। ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ে কোনও রাষ্ট্র এমন কোনও অভ্যন্তরীণ আইন করতে পারে না— যা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঐ অগ্রগতিকে লঙ্ঘন করে। কিন্তু অসমে তার উল্টোটাই ঘটেছে।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ‘অনুচ্ছেদ ১৫’-কে বিবেচনা করা হয় যেকোনও জনপদে রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা বড় নির্দেশনা হিসেবে। এই অনুচ্ছেদ ধরে নেয়, প্রত্যেকের অন্তত একটি দেশে নাগরিকত্ব থাকবে। এই বিবেচনায় কারও রাষ্ট্রবিহীন হওয়া বা কাউকে রাষ্ট্রবিহীন করা অন্তর্নিহিতভাবেই মানবাধিকারবিরোধী পদক্ষেপ। ‘নাগরিকত্ব’ বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে যেকোনও রাষ্ট্রনৈতিক পটভূমিতেই একজন মানুষের এমন একটা মৌলিক অধিকার— যা অন্যান্য মানবাধিকার পাওয়ার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এও দেখায়, কাউকে যুক্তিসঙ্গত কারণে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে হলেও পদ্ধতিগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান। কিন্তু অসমে অনেকের ক্ষেত্রে তাও করা হয়নি।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের উপরোক্ত অনুচ্ছেদের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মানুষের রাষ্ট্রবিহীনতা (statelessness) কমাতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৯৬১ সালে গ্রহণ করে ‘কনভেনশন অন দ্য রিডাকশন অব স্টেইটলেসনেস’। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘রাষ্ট্রবিহীনতা হ্রাস বিষয়ক সনদ।’ আন্তর্জাতিক এই সনদ অনুযায়ী প্রত্যেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে এটা দেখা, মানুষ যাতে রাষ্ট্রবিহীন না হয়ে পড়ে। ভারত এই সনদ এখনও অনুমোদন করেনি এবং অসমে ঘটিয়েছে উল্টোটি। ভারত রাষ্ট্রবিহীন মানুষদের মর্যাদা বিষয়ক রাষ্ট্রসঙ্ঘের ১৯৫৪ সালের সনদেও সম্মতি দেয়নি।
১৯৮৯ সালের ‘শিশু অধিকার সনদ’ও অসমে এনআরসি প্রক্রিয়ায় অবজ্ঞাত হয়েছে। যেখানে উল্লেখ রয়েছে, পূর্বপুরুষের ‘রাষ্ট্রবিহীনতা’র দায় কোনও শিশুর ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তায় না। কিন্তু অসমে তাই করা হয়েছে। অর্থাৎ পিতা-মাতার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মর্যাদা যাই হোক— প্রত্যেক শিশু জাতীয়তার অধিকারী হবে। ভারত এই সনদের অনুমোদনকারী পক্ষ হলেও অসমে সনদের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি।
একইভাবে ১৯৬৯ থেকে কার্যকর আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ সনদ (International Convention on the Elimination of All Forms of Racial Discrimination)-এর নির্দেশনাও লঙ্ঘিত হয়েছে অসমের ক্ষেত্রে। এটাও ভারতকর্তৃক অনুমোদিত একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং ভারতের সংবিধানের ৫১ (গ) অনুচ্ছেদে ‘আন্তর্জাতিক আইনি সনদসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা’র কথাই ছিল।
রাষ্ট্রীয় পরিচয়, নাগরিকতা, জাতীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নে ভারত নিজেকে যে কেবল আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সনদগুলোর আওতা বহির্ভূত করে রেখেছে তাই নয়— রাষ্ট্রহীনতা থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে দেশটিতে কার্যত কোনও একক আইনগত রক্ষাকবচই নেই। যেহেতু বরাবরই সংখ্যালঘুরা এইরূপ সঙ্কটের বলি হচ্ছে সেকারণে আইন নির্মাতাদের কাছে বিষয়টি অতীতে গুরুত্ব পায়নি। তবে ভারতীয় সংবিধানে এক্ষেত্রে পরোক্ষ যেসব রক্ষাকবচ ছিল তাও অসমে অনুসরণ করা হয়নি। যেমন, ভারতীয় সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ২১’-কে বলা হয় ঐ দলিলের আত্মাস্বরূপ। যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে কেবল ভারতীয় নাগরিককেই নয়— যেকোনও ব্যক্তিকে। কিন্তু কার্যত অসমে নথিপত্র চূড়ান্ত পরীক্ষা না করেই ভোটার তালিকায় কেবল বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের ‘সন্দেহজনক’ চিহ্নিত করে তাদের নাম পাঠানো হয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। সেখানে আবার অনেকের ক্ষেত্রেই পক্ষপাতমূলক রায়ে তাদের নাগরিকতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। উপরন্তু, যারা ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন— তাদের বিরুদ্ধে পুনরায় যে কাউকে আপত্তি উত্থাপনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে বিশেষভাবে লাখ লাখ মানুষকে চরম এক মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। যার কারণে অনেকেই আত্মহত্যাও করেছেন। জুলাই ২০১৯-এ এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত ভারতের স্থানীয় সংবাদপত্রে এনআরসি’র কারণে গ্লানি বোধকারী অন্তত ৫৭ ব্যক্তির আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের আরেকটি বহুল আলোচিত অনুচ্ছেদে (১৪ নং) আইনের দৃষ্টিতে সকল ব্যক্তিকে সমান এবং সমান সুরক্ষার দাবিদার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি সংশ্লিষ্ট ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে যাদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে আসবে না তাদের মধ্যে মুসলমান বাদে সকলকে (হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সকলকে) ছয় বছর বসবাস শেষেই থাকার সুযোগ করে দেয়া হবে। সরাসরিভাবে এখানে ধর্মের ভিত্তিতে আইন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। আরও সরাসরি বললে, নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী পরোক্ষে এই বার্তাই দেয়, ‘ভারত রাষ্ট্র’ মুসলমানদের জন্য নয়। কিন্তু কার্যত দেশটির সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে আছে ভিন্ন কথা।
আন্তর্জাতিক পরিসরে এটা প্রায় অবিতর্কিত এক ধারণা যে, সকল ব্যক্তির প্রতি একইরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া ন্যায়পরায়ণতার ধারণা অর্থহীন। কিন্তু এনআরসি সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার কখনও কখনও বাঙালি বিরোধী এবং কখনও আরও সরাসরিভাবে মুসলমান বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও নিজদের সংবিধানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। আর এটা বরাবরই সম্ভব হয়েছে ভারতে ‘রাষ্ট্রবিহীনতা’ সমস্যাকে ঘিরে সংবিধানসম্মত স্বতন্ত্র কোনও আইন না থাকায়।
ভারতে ‘রাষ্ট্রবিহীনতা’ শাসকদের ইচ্ছাধীন বিষয় হয়ে আছে
সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় রাষ্ট্রহীনতার প্রশ্নটি ভারতে বরাবরই শাসকশ্রেণির স্বার্থ এবং তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থতাড়িত একটা বিষয় হয়ে আছে। যেমন, চিন থেকে পালিয়ে আসা তিব্বতিরা ভারতে দশকের পর দশক যাবৎ খুবই আদৃত। এটা খুবই ভালো দৃষ্টান্ত যে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গা করে দেয়া হয়েছে, নিবন্ধন কার্ড, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এমনকি শরণার্থী তিব্বতিদের পরবর্তী প্রজন্মকে নাগরিক অধিকারও দেয়া হয়েছে। প্রায় অনুরূপ ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে অতীতে শ্রীলঙ্কার জাফনা অঞ্চল ছেড়ে তামিলনাড়ুতে আসা তামিল শরণার্থীদের ক্ষেত্রে। এমনকি শ্রীলঙ্কার চা বাগানে বহুকাল আগে দক্ষিণ ভারত থেকে নেয়া শ্রমিকদের জাতীয়তার জন্যও কলম্বোকে বহুকাল চাপ দিয়েছে নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু ভারতে অবস্থিত রোহিঙ্গা সহ সকল ধরনের মুসলমান শরণার্থীর ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূমিকা নেন। ২০১৭ সালে ভারতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বার্মায় ফেরত পাঠানোর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী দেশটিতে বিভিন্ন সময় প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বার্মা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়। সরকারের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সেখানে সুপ্রিম কোর্টে দু’জন রোহিঙ্গা একটা জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হল এই মামলাও বিচারের ভার পড়েছে অসমে এনআরসি প্রক্রিয়ার নির্দেশদাতা প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগইয়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এক বেঞ্চের উপর। উপরোক্ত জনস্বার্থ মামলায় বাদীরা দাবি করেছেন, ভারতীয় সরকারের সিদ্ধান্ত দেশটির সংবিধানের ১৪, ২১ এবং ৫১ (গ) ধারার লঙ্ঘন। এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত, ২০১৯-এর জুলাইয়ে, মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল।
তবে রোহিঙ্গারা এই অর্থে ভাগ্যবান যে, অপর দেশের নাগরিক হয়েও নিজেদের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছে। অসমের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেখানে কেবল যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে লাখ লাখ মানুষকে রাষ্ট্রবিহীন করা হয়েছে তাই নয়– সেটা ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে, তাদের বক্তব্য না শুনে। ২০১৯-এর ২ জুলাই ভারতীয় লোকসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কৃষাণ রেড্ডি জানিয়েছেন, অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ১৯৮৫ থেকে ২০১৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত প্রায় ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে কথিত ব্যক্তিদের তরফ থেকে বক্তব্য না শুনেই। অর্থাৎ এসব ব্যক্তিকে তাদের এতদিনকার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের মতামত ছাড়াই। তাদের আপত্তি না শুনেই। ভারতীয় লোকসভায় ভয়াবহ এই তথ্য প্রকাশের আগে অসমের বিধানসভায় এটা কোনও আলোচ্য বিষয় হয়নি। এমনকি ভারতে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আলোচনায় লাখ লাখ মানুষকে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ করা যে আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লঙ্ঘন হচ্ছে— সে প্রসঙ্গ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে সচরাচর এড়িয়েই যাওয়া হয়। রাষ্ট্রবিহীন মানুষকে সেখানে ‘বিদেশি’ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশি’!) হিসেবে উল্লেখ করার রেওয়াজ।
বিস্ময়কর হলেও ইতোমধ্যে অনেকে এইরূপ দাবি করেছেন যে, অসমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসমূহের লঙ্ঘন উৎসাহ পেয়েছে বৈচারিক পরিমণ্ডল থেকে। লাখ লাখ মানুষকে অসম থেকে বের করে দেয়ার (forced deportation) যে অনিবার্যতা এখন দেখা দিয়েছে তার প্রশাসনিক পটভূমি কোথা থেকে, কাদের দ্বারা তৈরি হল— সে প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে।
বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জাতীয়তা নিয়ে সন্দেহ করা, ‘সন্দেহ’ হলেই তাদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ ও ‘ডিটেনশন সেন্টার’-এ সোপর্দ করা এবং তাদেরই নিজস্ব জাতীয়তার পাঁচ দশক পূর্বেকার (১৯৭১ পূর্ববর্তী) প্রমাণ প্রদর্শনের দায়ভার বহনে বাধ্য করা হয়েছে। যা পদ্ধতিগতভাবে সরাসরি জাতিবিদ্বেষের স্মারক হিসেবে ভুক্তভোগীরা বলছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটার তালিকার এরূপ ‘সন্দেহভাজন’রা ছিল দরিদ্র চাষি সমাজের সদস্য। যাদের অনেকে বন্যা ও নদীভাঙনপ্রবণ চর এলাকার বাসিন্দা। তাদের পক্ষে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পূর্বেকার জমির দলিল বা ভোটার তালিকায় নথিবদ্ধতার প্রমাণ হাজির করা আটকাবস্থায় অনেক সময়ই সহজ নয়। এরূপ মানুষদের ক্ষেত্রে জাতীয়তার অধিকার না থাকা মানে প্রকৃত প্রস্তাবে অপর কোনও মানবাধিকার না থাকা। কিন্তু এতসব খারাপ শঙ্কা সত্ত্বেও ২০১৯-এর জুলাইয়ে আরেক বন্যার মাঝেই অসমে লাখ লাখ মানুষ চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রীয় পরিচয় হারাতে চলেছে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দিয়ে ট্রাইব্যুনাল!
অসমে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো পরিচালিত হতে দেখা গেছে উচ্চতর বিচার বিভাগের পরিণত ব্যক্তিদের দ্বারা নয়— মধ্য বা তার পরের সারির প্রশাসনিক ব্যক্তিদের দ্বারা, যাঁদের মাঝে অসমিয়ারাও আছেন এবং বিবাদীদের সঙ্গে যাদের ‘স্বার্থের সংঘাত’ (conflict of interest) রয়েছে। এইরূপ সন্দেহভাজনদের বিষয় যেসব ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হচ্ছে— তাদের সম্পর্কে ভারতের উদ্বাস্তু আন্দোলনের সংগঠক সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস লিখেছেন:
ট্রাইব্যুনালে যাঁরা বিচার করেন, তাঁরা এ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী বা এ ব্যাপারে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত বিচারক নন; তাঁদের বেশিরভাগই অতীতের বাঙ্গালি খেদাও আন্দোলনের নেতা কর্মী।
অথচ এইরূপ বিচারকদের মাধ্যমেই লাখ লাখ বাঙালিকে (বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের) সন্দেহজনক ভোটার চিহ্নিত করে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে পদ্ধতিগতভাবে।
২০১৯-এর শুরুতে এইরূপ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ছিল ১০০ এবং একই বছরের জুলাইয়ের পর প্রায় এক হাজার উক্তরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এসব ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রয়োজন ১২ হাজার বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা। যার যোগান দেয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে এসব ট্রাইব্যুনালের ‘বিচারক’দের মানের বিষয়ে ইতোমধ্যেই আপস করা হয়। বলা হয়েছে, কারও সাত বছর আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকলে বা মধ্য পর্যায়ের অবসারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেও তিনি অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্য হতে পারবেন। অথচ এইসব ‘বিচারক’কে যাচাই বাছাই করতে হবে কয়েক দশকের পুরানো ভূমি ও বহুধরনের প্রশাসনিক দলিলদস্তাবেজ এবং তাঁরা সিদ্ধান্ত নিবেন একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ জরুরি মর্যাদাসংক্রান্ত বিষয় ‘নাগরিকত্ব’ ও ‘জাতীয়তা’ নিয়ে। কথিত এসব বিচারকদের সিদ্ধান্ত দ্বারাই এসব ব্যক্তিকে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ করে দেয়া হবে বা (স্থানীয় প্রচার মাধ্যমের ভাষায়) ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে অসম থেকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটতে পারে।
অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও তার ‘বিচারক’দের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহের কারণ এখানেই সীমিত নেই। যদিও এগুলোকে বৈচারিক ট্রাইব্যুনাল বলা হচ্ছে— কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে অসম সরকারের হাতে। কারণ Foreigners (Tribunals) Amendment Order অনুযায়ী এইরূপ ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের রাজ্য সরকার বাদ দেওয়ার অধিকার রাখে। যে রাজ্য (এবং কেন্দ্রীয়ও) সরকার পরিচালনা করছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের জোট সরকার। অর্থাৎ কার্যত বিজেপি নেতৃত্বের হাতেই থাকছে ট্রাইব্যুনালের নিয়ন্ত্রণ। যে ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে মূলত রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন মুসলমানদের। স্বভাবত এইরূপ ট্রাইব্যুনালে ‘ন্যায়বিচার’ নিয়ে গভীর সন্দেহ জারি আছে। এইরূপ ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা ন্যায়বিচারের জন্য কার কাছে জবাবদিহি করবেন— আদৌ করবেন কি না তা অস্পষ্ট। যেহেতু বলা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই মুখ্যত বিচারক হবেন— সেক্ষেত্রে তাদের চাকুরিগত জবাবদিহিতার কোনও অবকাশ নেই। সর্বশেষ উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যারা চূড়ান্তভাবে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ ঘোষিত হচ্ছে সেইসব অসন্তুষ্ট বিবাদীরা গৌহাটি হাইকোর্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করতে যেয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন বলে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিনিধিদলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
‘রাষ্ট্রবিহীন’রা যাবেন কোথায়?
এ মুহূর্তে অসমে বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে চূড়ান্ত এনআরসিতে অন্তত ২০ লাখ মানুষও যদি বিদেশি ঘোষিত হন এবং তাঁদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল শুনানি শুরু হয়— তাহলে গড়ে প্রতি ট্রাইব্যুনালে অন্তত দুই হাজার মামলা নিষ্পত্তির জন্য জমা হবে। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল যদি প্রতিটি আবেদন একদিনেই ফয়সালা করে (যা প্রায় অসম্ভব) তাও প্রতিটি ট্রাইব্যুনালের অনেক আবেদনকারীকে অন্তত ৫-৬ বছর করে ডিটেনশন সেন্টারে আটক থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমনকি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে চূড়ান্তভাবে ‘নাগরিকত্বহীন’ হিসেবে রায় পেয়ে ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পেলে এসব ব্যক্তির ঠাঁই হবে কোথায়— বিশেষ করে যখন অসমের কারাগারগুলোতেও ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি রয়েছে। এ বিষয়ে অসমে কিংবা ভারতে কেউ কিছু বলছে না। এ বিষয়ে ঘোষিত কোনও দাপ্তরিক নীতি নেই ভারত সরকার কিংবা অসম সরকারের। অর্থাৎ লাখ লাখ মানুষকে রাষ্ট্রবিহীন করেই যেন ভারতরাষ্ট্র তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। এমনকি তাদের আটকের অবকাঠামো নিয়েও ভারত চিন্তিত নয়।
স্বাধীনতার ৭২ বছর পরও ভারতের মতো একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রবিহীনতা’র সমস্যা নিয়ে এইরূপ আইনগত উদাসীনতা বিস্ময়কর। এর ফলে কার্যত নাগরিকত্বহীন একজন ব্যক্তি ভারতে কোনও ‘আইনগত সত্তা’ আকারেই আর থাকছে না। এইরূপ আইনগত সত্তাহীন ব্যক্তিরাই কার্যত ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে ‘বিদেশি’! আরও খোলামেলাভাবে বললে ‘বাংলাদেশি’। অর্থাৎ যা ভারতের আইনগত পরিমণ্ডলের সমস্যা— তাকে রূপ দেয়া হচ্ছে প্রতিবেশীকে বিষোদ্গারের চিরস্থায়ী এক উপায়ে। পাশাপাশি ‘রাষ্ট্রবিহীন’দের সামাজিকভাবে হেয় করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। রাজ্য ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি ২০১৯-এ জাতীয় নির্বাচনকালে তাদের ইশতেহারে এও জানিয়েছে, অসমের পর দেশের অন্যত্রও তারা এনআরসিরূপ প্রক্রিয়া শুরু করতে ইচ্ছুক।
অসমে এনআরসি প্রক্রিয়ায় এইরূপ অদ্ভুত সুযোগও রাখা হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি এক ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্বের বিষয়ে ইতিবাচক রায় পেলে, অর্থাৎ তাঁর নাগরিকত্ব স্বীকৃত হলেও তাঁর বিরুদ্ধে একই ট্রাইব্যুনালে পূর্বতন রায়ে আপত্তি উত্থাপন করে আবার মামলা দায়ের করা যায় এবং ঐ ব্যক্তির নাগরিকত্ব তখন আবার ‘সন্দেহজনক’ বিবেচিত হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, প্রশাসন নয়— যেকোনও সাধারণ ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই এইরূপ ‘আপত্তি’ তোলার ‘অধিকার’ দিয়ে রাখা হয়েছে। এই সুযোগে অসমীয়া তরুণরা বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার প্রয়োগও করেছেন বেপরোয়াভাবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কেবল ২০১৮-র ডিসেম্বর পর্যন্ত নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া মানুষদের বিরুদ্ধেও এইরূপ দুই লাখ ‘আপত্তি’ পেশ করে রাখা হয়েছে।
কৌতূহল উদ্দীপক দিক হল এইরূপ আপত্তি নিয়ে শুনানিকালে আপত্তি উত্থাপনকারীরা না এলেও সেই আপত্তি খারিজ হচ্ছে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯-এর ৮ মে এক নির্দেশনায় এমন অভিমতই দিয়েছে যাতে পরোক্ষে প্রমাণিত হয়— এনআরসিতে ইতোমধ্যে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্তদের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপনকারীরা আদালতে না এলেও উক্ত মামলাগুলো চলতে কোনও সমস্যা নেই।
অর্থাৎ ভারতে একদিকে যেমন রাষ্ট্রবিহীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও স্বতন্ত্র আইন নেই— তেমনি আবার রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার অন্তহীন একটা প্রক্রিয়া অসমসহ বিভিন্ন স্থানে আইনগতভাবেই তৈরি করা হয়েছে বা হওয়ার প্রক্রিয়া রয়েছে বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য। যে প্রক্রিয়া আবার দেশটির সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
এনআরসি প্রক্রিয়ায় অসমে বিভিন্ন রূপে মানবাধিকার লঙ্ঘন থামাতে এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘ অন্তত তিন বার ভারতকে চিঠি দিয়েছে। বহু ধরনের উদ্বেগ ও করণীয় সম্পর্কিত এইরূপ চিঠি দেয়া হয় ২০১৮-র ১১ জুন, ১৩ ডিসেম্বর এবং ২০১৯-এর ২৭ মে। সর্বশেষ তারিখে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পাঁচ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভারতকে প্রায় তিরস্কার করেই একটি চিঠি লেখেন। যেখানে বলা হয়: ‘ভারত অসম বিষয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কোনও অনুসন্ধান ও উদ্বেগেরই উত্তর দেয়নি।… রাষ্ট্রসঙ্ঘের এ বিষয়ে সংলাপের স্বীকৃত অধিকার রয়েছে— বিশেষত যে ঘটনায় লাখ লাখ মানুষের মানবাধিকার বিপর্যয়ের শঙ্কা বিদ্যমান এবং যারা সংখ্যালঘু ও রাষ্ট্রবিহীন হওয়া, দীর্ঘস্থায়ী আটকাবস্থা এবং এমন কোথাও জোরপূর্বক প্রেরণের চরম ঝুঁকির মাঝে রয়েছে— যেখানে তারা কোনওদিন থাকেনি অতীতে।’