এই সময় কোক-স্টুডিও কেন বাংলায়?

কোকাকোলা কম্পানি কোন সঙ্গীতঘর নয়। তবে তারা সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহী। এ খাতে তারা অর্থ খরচ করছে। তাদের গানের ‘স্টুডিও’ দর্শক-শ্রোতাদের মাতাচ্ছে। সেই পথ ধরে কোকস্টুডিও ‘বাংলা’য়ও এসে গেছে। এই আসার বড় এক কারণ অবশ্যই এখানকার পানীয় বাজারের উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বাংলাদেশে কোমল পানীয়’র বাজারের আকার প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। অনেক উৎপাদক থাকলেও বেশ সুবিধাজনক ‘পরিবেশে’ ড্রিকংসের কারবার করা যায় এখানে। ১০ শতাংশ হারে এই বাজার বাড়ছে।
উদীয়ামান এই বাজারে দেশীয় ড্রিংকস্ ব্যবসায়ীদের কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে চায় কোকাকোলা। তবে অর্থনীতির হিসাবপত্তরের বাইরেও কোকাকোলাকে গানের জলসায় উৎসাহ যোগাতে আগ্রহী কর্পোরেটমহল। সমাজে অর্থনৈতিক বঞ্চনার মেরুকরণ যেভাবে তীব্র হচ্ছে তাতে ব্যাবসার শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি বাড়ানো দরকার। নাচ, গান ইত্যাদির মাধ্যমে সেরকম ইমেজ তৈরি করা যায় সহজে। ‘কোক-স্টুডিও-বাংলা’ তাতে সাহায্য করতে পারে। নিশ্চয়ই করবেও।
পুঁজিতান্ত্রিক প্লাটফর্ম থেকে বৈপ্লবিক গান!
এই লেখা প্রকাশের আগেই বাংলাভাষীদের মাঝে কোক-স্টুডিও তার পণ্য ছাড়তে শুরু করেছে। কোকের বিশাল লাল লোগোর আড়াল থেকে বাংলা গানের কিছু নিরীক্ষা দেখবো আমরা এখন। পাকিস্তান ও ভারতের অনুরূপ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় বাংলাদেশেও গানের ভৌগলিক ও জাতিগত বৈচিত্র্য তুলে ধরবে কোক।
স্থানীয় লোকজ গানের ধারাকে কোক-স্টুডিও নতুন মোড়কে উপস্থাপন করে সচরাচর। তাদের কম্পোজে থাকে মুন্সিয়ানা। কোক-বাংলার কাজও স্থানীয় শ্রোতার মনযোগ কাড়বে আশা করা যায়। অনেক নতুন সঙ্গীত ‘তারকা’ পাবে ‘বাংলা’ শিগগির। এই তারকাদের নিয়ে বিজ্ঞাপন জগতের ব্যাপক কর্মতৎপরতাও দেখা যাবে। সব মিলে ‘কোক-স্টুডিও বাংলা’ আমাদের সংগীত জিডিপি’র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা আছে। পাকিস্তানে সফল হওয়ার অভিজ্ঞতাও তাদের কাজে লাগবে।
পাকিস্তানে কোক-স্টুডিও বাজিমাৎ করেছে মূলত সুফি ধারার গানের জন্য। এটা বেশ কৌতুককরই ছিল– যে কম্পানির মূল লক্ষ্য মুনাফা– তারা সুফি মূল্যবোধের জয়গান তুলে ধরছে। যে মূল্যবোধ সচরাচর ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে মানবতার কথা বলে। তবে কোকস্টুডি-পাকিস্তান স্থানীয় গানের জগতের অনেক প্রান্তিক ধারা এক জায়গায় জড়ো করেছিল এবং সমন্বয়বাদী দর্শনের বাড়তি আবেদন তৈরি করতে পেরেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তারা মঞ্চে এনে সাহসী কাজ করেছে। এসবই ঘটেছে যখন রাজনৈতিকভাবে সেখানে বহুজনবাদ প্রায় পরাজিত। এও বেশ কৌতুককর ছিল যখন কোকাকোলার মতো পুঁজিতান্ত্রিক প্লাটফর্ম থেকে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’র মতো বৈপ্লবিক গান বেজেছে। তরুণ শ্রোতারা সাদরে নিয়েছে এসব ‘ফিউশন’।
কোকস্টুডিও-পাকিস্তানের গানে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সুফি দর্শনের প্রভাব সেখানকার শাসকদের জন্যও বিশেষ উপকারি হয়েছে। কোক তাদের গানের আসরে বরাবরই দেশপ্রেমমূলক গানও রাখে, সেটাও শাসক-এলিটদের খুশী রাখে।
আন্তঃধর্মীয় সংঘাত এবং ধর্মীয় সহিংতার জন্য পাকিস্তানের যে বদনাম তার বিপরীতে বহির্বিশ্বে দেশটির শান্তিবাদী ও মডারেট ব্র্যান্ডিং চায় সেখানকার শাসকরা। এ কাজের জন্য সুফি ইসলামে সহায়ক উপাদান আছে। সুফি ইসলাম যে ইউরোপ-আমেরিকার উদারনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় সেটাই বলতে চান পাকিস্তানে অনেকে। কোক তাঁদের এই চাওয়াকে ভাষা দিয়েছে। কোকের কল্যাণে ইউটিউবে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বেশ বিপ্লবাত্মক বলতে হবে। যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখানকার শাসক-এলিটদের কাছে ধর্মীয় সহিংসতা একটা ভালো পণ্য। সীমান্তের ভেতরে-বাইরে সুফী দর্শনবিরোধী রেডিক্যালদের ভালোভাবেই লালন-পালন করেছে তারা। বিভিন্ন এজেন্সি সেখানে ঐ ‘রেডিক্যাল’দের নানানভাবে ব্যবহার করে বিস্তর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করেছে। পাশাপাশি কোক-স্টুডিওর মতো কর্মসূচি সফল বিক্রেতা হয়েছে সুফি ইসলামের। যদিও সুফিচিন্তার জন্ম মোটেই পুঁজিতন্ত্রের ক্ষুধা মেটানোর জন্য হয়নি– বরং রাজনৈতিক-সামাজিক তাগিদ থেকে হয়েছিল। আজও সমাজে সেই তাগিদ বোধ করে মানুষ। আর মানুষের পরিবর্তন চাওয়ার ঐ বাসনাতে বাজি ধরেছে কোক। তার ব্যাণিজ্যিক বোঝাপড়া ব্যর্থ হয়নি।
যে কারণে শ্রোতা-দর্শককে ইউটিউবে একবার উঁকি দিতেই হয়!
কম্পানি হিসেবে এবং ব্র্যান্ড হিসেবে কোক অনেক বড় কিছু। বিলিয়ন ডলার কম্পানি বলা হয় তাদের। এই ব্র্যান্ড আমেরিকার শক্তিমত্তার প্রতীকী প্রকাশও বটে। তবে সব দেশে এবং অঞ্চলে যে সফট ড্রিংকসের বাজারে তাদের আধিপত্য আছে তা নয়। বাংলাদেশে এ খাতের অন্যান্য কম্পানি পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের তুলনামূলকভাবে বেশি ‘সুবিধা’ দেয়ায় কোকের জন্য বাজার অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। পাকিস্তানেও তারা পেপসির সঙ্গে পেরে উঠছিল না অনেক দিন। ভারতের তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছে বোভোন্তো, জয়ন্তী কোলার মতো ‘দেশী’রা। এরকম পরিস্থিতির মোকাবেলায় বিজ্ঞাপন বড় হাতিয়ার। তরুণদের পছন্দের প্রায় সকল খাতে বিজ্ঞাপনী অধিকার পেপসির কব্জায় ছিল দীর্ঘকাল। কোক তখন পপগানের জগতকে বেছে নেয় তরুণ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে।
কোক যখন কিছু বলতে চায় তখন সেটা প্রতিষ্ঠার মতো যথেষ্ট জ্বালানী থাকে তার হাতে। পাকিস্তান কোক-স্টুডির যেকোন নতুন ‘সিজন’-এর আগে শহরগুলোর সব বিলবোর্ড তাদের দখলে চলে যেতে দেখা যেতো। সুতরাং শ্রোতা-দর্শককে ইউটিউবে একবার উঁকি না দিয়ে উপায় থাকে না। ‘বাংলা’তেও কমবেশি তাই হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন পানীয়ের ব্যবসা বাড়াবে
কোক সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহী হওয়ার বড় কারণ তরুণ-তরুণীদের ভোক্তা বানাবার খায়েশ থেকে। কোকের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি পেপসিও একই লক্ষ্যে সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহী। বিশাল অঙ্কের সম্মানিতে মাইকেল জ্যাকসন পেপসির হয়ে কাজ করেছেন একসময়।
পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পপসঙ্গীতের ব্যাবহার সফট ড্রিংকস উৎপাদকদের ভালো এক কায়দা। পপসঙ্গীত এবং হালকা পাণীয়ের মাঝে তারুণ্যকে খোঁজার একটা স্মার্ট ছবি বহুকাল থেকে জনমানসে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। কোকস্টুডিও সেই ধারাবাহিকতায় বেশ সৃজনশীল সংযোজন। পপের সঙ্গে সুফিবাদের ফিউশন করেছে তারা! অসংখ্য দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন দর্শক তাদের গানের অনুষ্ঠান দেখছে এবং পাকিস্তানে এই পথেই তারা পেপসির বাজার হিস্যার এক অংশ নিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে।
বাজার দখলে-বেদখলের যুদ্ধের অংশ হিসেবে কোকের যে অর্থ শিল্পীদের পকেটে যায় সেটা কোমল পানীয় ভোক্তারই টাকা। ক্রেতাকে একবার সেটা দিতে হচ্ছে বোতল কেনার সময় পানির দাম হিসেবে– আরেকবার গান শোনার সময় ইন্টারনেটের খরচ হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশীরা বছরে মাথাপিছু গড়ে ১৭-১৮ বোতল সফট ড্রিকংস খায়। কোকস্টুডিও-বাংলার কল্যাণে এ পরিমাণ বাড়বে নিশ্চয়ই। যেসব দেশে জনসংখ্যায় তরুণদের অংশ বেশি সেখানেই এই পণ্যের বাজার সম্ভাবনা বেশি। ‘বাংলা’ এমুহূর্তে এই ফর্মূলাতে পড়েছে।
বাজার-পন্ডিতদের পুরানো একটা ধারণা ছিল– নগরায়নের মাধ্যমে পাণীয়ের বিক্রি বাড়ে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীদের আয় বাড়ার কারণে গ্রামাঞ্চলেও সফট ড্রিংকসের চাহিদা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। জলবায়ুর পরিবর্তনও ড্রিংকস উৎপাদকদের জন্য সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে এসেছে এখানে। তাপমাত্রার আধিক্য এই ব্যবসাকে বাড়তি উদ্দীপনা যোগাবে বলে ভাবা হচ্ছে।
ব্যবসায়ের স্বার্থেই বহুত্ববাদের ‘ফিউশন’ দরকার
তরুণদের ক্রেতা ও ভোক্তা হিসেবে কাছে টানতে উপমহাদেশে ভালো পণ্য হলো ক্রিকেট ও গান। এই দুটো জিনিস দক্ষিণ এশিয়াতে তরুণ সমাজকে আবেগে উদ্বেল করে। দুটোই বেশ নেশার মতো। সমাজে অন্যায় অত্যাচার যতই থাক– ক্রিকেট এখানে ‘জাতিকে এক কাতারে’ নিয়ে আসে তাৎক্ষণিকভাবে। মজলুম ও জুলুমকারী আনন্দের সঙ্গেই তখন পাশাপাশি আবিষ্কারে করে নিজেদের। এটা দারুণ এক ‘ফিউশন’। একই কথা বলা যায় ঐতিহাসিক লোকজ গানগুলো নিয়ে। সেগুলোর এক ধরনের শান্তিবাদী ইমেজ আছে–যা কর্পোরেটদের এমুহূর্তে খুব দরকার। কিছু কিছু নিরীক্ষায় দেখা গেছে ক্রিকেটের চেয়েও গান ব্যবসা ছড়াতে ভালো কাজে দেয়। যেমন, রাজনীতিতে বহুত্ববাদ না থাকলেও বাউল বা সুফী-রকের ফিউশন বেশ ভালো রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে কর্পোরেট স্বার্থে। সুফী এবং রক– উভয়ের মাঝে খানিক বিদ্রোহী ভঙ্গী আছে। তবে কোন্ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে দুয়ের ফিউশন হচ্ছে সেই আলাপ না থাকাই ব্যবসার দিক থেকে ভালো! সুতরাং পাকিস্তানে যে কারণে– কোকস্টুডিও বাংলার বিনিয়োগও একই প্রয়োজনে।
ফেব্রুয়ারি বাঙালিদের ভাষার মাস। এ মাসে ‘হাজং ভাষা’র একটা গান দিয়ে কোক-স্টুডিও ‘বাংলা’য় যাত্রা করলো। শুরু হিসেবে এটা বেশ সাহসী। এরকম সাহস বাংলার সংস্কৃতির পুরানো শক্তির জায়গারই প্রকাশ। তবে নিঃসন্দেহে কনজুমারিজমই এই সাহসের চালিকাশক্তি। কোকস্টুডিও বাংলার প্রথম গানের প্রথম লাইন সেই অর্থে বেশ নজরে রাখার মতো, ‘নাসেক নাসেক হাপাল গিলা’। যার অর্থ ‘নাচো নাচো কচিকাঁচার দল’! কিন্তু পেছন ফিরে তাকলে দেখবো হাজংদের জন-ইতিহাস এত বেশি আনন্দদায়ক নয়। উদ্দাম নাচের আহ্বানের মাঝে এই তথ্য অনেকের কাছেই বিব্রতকর ঠেকবে যে হাজংরা বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা। দীর্ঘ এক উপনিবেশিক ইতিহাসের জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই সম্প্রদায় আজও।
তারপরও আপাতত বাঙালিদের সঙ্গে হাজংদেরও নাচতে হবে।
আশা করা যায়, নতুন ক্রেতা খুঁজতে কোকের গানে সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির ফিউশনের পাশাপাশি দেশাত্মবোধক গানগুলোরও রি-কমপোজ হবে। ঐতিহ্যের ঐ ক্যাপসুলগুলোতে কল্পিত এক সমৃদ্ধ বাংলাকে পাবে স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা।
আধ্যাত্মবাদী ধারার বাংলা গানের প্রতি কোক-স্টুডির যে বিশেষ পক্ষপাত থাকবে সেটা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাৎ বাউলিয়ানার নতুন করে পণ্যায়ন হবে সামনে। বাংলাদেশকে আধ্যাত্মিক শান্তির সমাজ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হতে পারে। যদিও জীবন ও বাস্তবতা আপাতত তেমন নেই আর। কোটি কোটি মানুষকে সামান্য সস্তায় পেয়াজ-তেল-ডাল পাওয়ার জন্য তীব্র রোদের মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু এখানকার সাংস্কৃতিক ক্ষুধা যে এরকম জান্তব পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গেও বেশ মানানসই সেটাই দেখবো আমরা ‘কোক-স্টুডিও-বাংলা’র সুরে, মূর্ছনায়।
আসুন, গান শুনি। নাসেক–নাসেক!!
শেয়ার করুন: