আসুন, ইউক্রেন যুদ্ধের মূল (খল)নায়কের সঙ্গে পরিচিত হই

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর রুশরা দেশের বাইরে এ পর্যন্ত অনেক সামরিক অভিযান চালিয়েছে। জর্জিয়া (২০০৮), ক্রিমিয়া (২০১৪), বেলারুশ (২০২০), কাজাখস্তানের (২০২২) পর ইউক্রেনের (২০২২) জমিনে নেমেছে তাদের জওয়ানেরা। কোথাও দেশ দখল, কোথাও কোনো দেশের অংশবিশেষ দখল, কোথাও নিজের পছন্দের একনায়ককে জনরোষ থেকে রক্ষা, কোথাও ‘স্বাধীনতা’কে মদদ দিতে এসব অভিযান চালানো হয়েছে।

নিজদের সীমানার চারদিকে রাশিয়ার ধারাবাহিক এসব সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম বর্তমানে এককভাবে পুতিনকে একজন যুদ্ধবাজ উত্তেজক শাসক হিসেবে তুলে ধরছে। তাঁকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ও বলতে চাইছে তারা। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার দিক থেকে এসব অভিযান কোনো একক ব্যক্তির সামরিক রোমাঞ্চ নয়। প্রতিটি অভিযানের পেছনে আছে রুশদের ভবিষ্যৎ ভৌগোলিক পরিকল্পনার ব্যাপক সমন্বিত ভাবনাচিন্তা। রাশিয়ার চলমান সমরদর্শনকে বুঝতে আমাদের পুতিনের দিক থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে তাকাতে হবে আলেকসান্দর দাগিনের দিকে, পুতিনের অন্যতম উপদেষ্টা যিনি।

কে এই আলেকসান্দর দাগিন

৬০ বছর বয়সী দাগিনকে বলা যায় চলতি রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের শিরোমণি। সমালোচকেরা তাঁকে উগ্র জাতীয়বাদী বলেন বটে, কিন্তু রুশ শাসকশ্রেণির ওপর তাঁর ব্যাপক প্রভাবকে অস্বীকার করেন না।

দাগিন অত্যন্ত মেধাবী পুরুষ। বহু ভাষায় অনর্গল বলেন। একসময় মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন। দাগিনের নিজস্ব ওয়েবসাইটটি (দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি) কয়েক ডজন ভাষায় তাঁর চিন্তাকে ছড়িয়ে চলেছে। ওই ওয়েবসাইটে স্পষ্টভাবে দাগিন নিজের সম্পর্কে লিখে রেখেছেন, ‘যিনি বাম ও ডানের সীমানায় আটকে নেই—তবে অবশ্যই মধ্যপন্থীদের বিরুদ্ধে’! ‘মধ্যপন্থী’ বলতে দাগিন উদারনৈতিক গণতন্ত্রীদের বোঝান। দাগিনের স্বঘোষিত ‘প্রতিপক্ষ’ উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক আদর্শ আর এই আদর্শের বড় কেন্দ্র হিসেবে রয়েছে আমেরিকা।

মস্কোতে জন্ম নেওয়া দাগিন বড় হয়েছেন সমাজতন্ত্রের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। তবে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি গণতন্ত্রমুখী হননি, বরং ইউরোপের দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ভাব করেছেন ধীরে ধীরে। নিজের রাজনৈতিক দর্শনে যুক্ত করেছেন আধ্যাত্মবাদ ও ধর্মকে। তাঁর পাঠক ও শ্রোতাকে সব সময় ‘পুরোনো সোনালি দিনগুলো’-র স্বপ্ন দেখান দাগিন—যেখানে চলতি উদারনৈতিক গণতন্ত্র থাকবে না, যেখানে ‘রাষ্ট্র’ হবে সর্বেসর্বা, যেখানে প্রচারমাধ্যম কেবল ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর কথা শোনাবে।

এ রকম এক ভবিষ্যৎ ত্বরান্বিত করতে দাগিন রাজনৈতিক কাজে হাত লাগানোর তাগিদ দেন সবাইকে; বিশেষ করে রুশদের। সেই তাগিদের ফসল তাঁর ‘ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিকস’ গ্রন্থ। এখানে তিনি দেখান কীভাবে রাশিয়াকে আবার আশপাশের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জায়গায় যেতে হবে। বইটি দ্রুত রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও রাশিয়ার বিভিন্ন সামরিক প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য হয়ে গেছে। রাশিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ের জেনারেলদের সঙ্গে নিয়ে দাগিন যৌথভাবে অনেক কিছু লেখেন প্রায়ই। এতে তাঁর প্রভাববলয় সম্পর্কে ভালোই ধারণা মেলে।

প্রথম জীবনে দাগিন ন্যাশনাল বলশেভিক পার্টির ব্যানারে ভোটাভুটির রাজনীতিতে নেমেছিলেন। সুবিধা করতে পারেননি। এরপর তিনি পুরো রাজনৈতিক কৌশল পাল্টান। মেঠো রাজনীতির বদলে রাশিয়ার শাসক এলিটদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দিয়ে প্রভাবিত করার পথে নামেন এবং সফল হন। দাগিন তাঁর এই কৌশলের নাম দিয়েছেন অধিরাজনীতি (মেটা-পলিটিকস)। তাঁর মতে, রাজনীতিতে সফল হওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পাল্টানো এ সময়ে জরুরি।

এ কাজকেই তিনি বলছেন অধিরাজনীতি। ইউরোপে অনেকে দাগিনের এই অধিরাজনীতিকে আন্তোনিও গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্বের একধরনের নবায়িত রূপ হিসেবে দেখছেন। যদিও গ্রামসির শ্রেণি লক্ষ্য দাগিনের বিপরীত; সে জন্য দাগিনকে ‘দক্ষিণপন্থী গ্রামসি’ও বলা হচ্ছে।

দাগিন যা চাইছেন

দাগিন মনে করেন, সাম্য ও সমানাধিকার একটা বাতিল ধারণা। ইউরোপকে এখন মনোযোগ দিতে হবে ‘ইউরেশিয়া’ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায়, যে সাম্রাজ্যে নায়কের আসনে থাকবে রুশরা। অর্থাৎ এটা হবে ‘বৃহত্তর এক রাশিয়া’, যে সাম্রাজ্যে দাপট থাকবে কেবল পুরোনো ধর্ম ও রাজনৈতিক কাঠামোর। অর্থাৎ রাজনীতি ও প্রশাসনে রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, ধর্ম ও চার্চের প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চান দাগিন। পুরোনো সামাজিক বন্ধনকে খাটো করে এমন সব নাগরিক স্বাধীনতার বিপক্ষে তিনি।

এ রকম ভাবনার কারণে দাগিনকে রাশিয়ার বাইরে ইউরোপের অনেক উগ্র জাতীয়তাবাদীও গুরু মানছে। তুরস্কের জাতীয়তাবাদীদেরও তিনি বেশ আকর্ষণ করছেন। দাগিনের প্রভাব বাড়ছে আমেরিকার রিপাবলিকানদের ওপরও। ট্রাম্প যে ‘লৌহমানব’ পুতিনের ক্রমাগত প্রশংসা করতেন এবং নিজেও ওই রকম এক শাসক হওয়ার গোপন বাসনা পোষণ করতেন, তাতে দাগিনের অবদান আছে।

পুতিনকে ‘লৌহমানব’ করে তুলেছে দাগিনের দর্শন। আর দাগিন নিজে তৈরি হয়েছেন ইতালির ফ্যাসিস্ট জুলিয়াস ইভোলার আদর্শিক প্রভাবে। ইভোলাকে মনে করা হয় আধুনিক ইউরোপের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অন্যতম গুরু। এই ইভোলার ভক্ত আবার যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদের অনেকে; বিশেষ করে স্টিভ ব্যানন, যে ব্যানন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন। এদিক থেকে দাগিন ও আমেরিকার অনেকের মধ্যে দার্শনিক দূরত্ব বেশি নয় এবং তাঁরা পরস্পরের চেনাজানা।

পুতিন ও দাগিন কতটা ঘনিষ্ঠ জুটি

ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পুতিনকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সাংবাদিকদের লেখায় বিদ্বেষের ঝাঁজ বেড়েছে। তবে এটুকু মোটেই মিথ্যা নয়, পুতিনের ভাবনা-চিন্তা-সিদ্ধান্তে দাগিনের বেশ প্রভাব আছে। কেউ কেউ দাগিনকে বলছেন পুতিনের ‘রাসপুতিন’। আরও বেশি খোঁজখবর রাখা ব্যক্তিরা বলছেন দাগিন হলেন ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’।

লেনিন-ট্রটস্কিদের বিপ্লবের আগে রাশিয়ার রাজতান্ত্রিক দিনগুলোয় শাসক জার-পরিবারে পুরোনো রাসপুতিনের প্রভাবের কথা সবার মনে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই রাসপুতিন ও আজকের দাগিনের চেহারায় অবিশ্বাস্য মিল। জারদের আমলের রাসপুতিন যেভাবে শাসকদের সম্মোহিত করতেন, দাগিনও একালের রাশিয়ার অভিজাতদের আরও বড় সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

দাগিনের ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিকস’ বইটিকে পুতিনের গত ২০ বছরের বিদেশনীতির গাইড বই হিসেবে গণ্য করা যায়। অন্যভাবে বললে, দাগিনের ‘স্বপ্ন’ বাস্তবায়ন করতেই হয়তো পুতিনকে দুমার সাহায্য নিয়ে সংবিধানে অদল-বদল ঘটিয়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে; ১৯৯৯ সালে শুরু হয়ে ইতিমধ্যে যে শাসনের প্রায় দুই যুগ হতে চলল।

ইউক্রেন আগ্রাসনে কি দাগিনের কোনো ভূমিকা আছে

রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনে ঢুকে পড়া নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্ময় তৈরি হলেও এ ঘটনা যে ঘটানো হবে, সেটা দাগিন ২০০৮ সালেই বলে রেখেছিলেন। সে সময় জর্জিয়ায় রুশদের অভিযানের সময় দাগিন দক্ষিণ ওশেতিয়ায় গিয়েছিলেন এবং জর্জিয়ায় তাঁর দেশের সামরিক অভিযান সমর্থন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তিবলিশ, ক্রিমিয়া, ইউক্রেনসহ এসব অঞ্চল রুশদের।’

সর্বশেষ আগ্রাসনকালে ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন হতে পুতিন যেভাবে উৎসাহ জোগালেন, ঠিক সেভাবেই ২০০৮ সালে দক্ষিণ ওশেতিয়াকে ‘স্বাধীন’ করে রাশিয়া নিজ কবজায় নেয়। দাগিন সে সময় দক্ষিণ ওশেতিয়ায় রকেট লাঞ্চার হাতে প্রতীকী ছবি তোলেন এবং সেটা ইন্টারনেট জগতে তুমুল সাড়া ফেলে।

জর্জিয়া, ইউক্রেনসহ আশপাশের দেশগুলোর ভেতরে রাশিয়ামুখী

স্বাধীনতাসংগ্রাম’গুলোকে দাগিন মনে করেন ‘রুশ বসন্ত’। জর্জিয়ার দক্ষিণ ওশেতিয়া, ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ইত্যাদি এলাকায় যারা রুশ বসন্তের গোড়াপত্তন করেছে, সবাই দাগিনের ভক্ত। দাগিন আলাপ-আলোচনায় বরাবরই ইউক্রেনকে ‘নিউ রাশিয়া’ বলতেন। পুতিনও এখন সেটাই অনুসরণ করেন। জর্জিয়ায় সেনা প্রেরণকালে দাগিন পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির উপদেষ্টা ছিলেন। আর এখন তাঁকে পুরো রাশিয়ার সমরদর্শনের মুখপাত্র মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়া যখন জর্জিয়ায় সেনা পাঠায়, দাগিন সে সময় ২০০ ‘স্বেচ্ছাসেবক’ নিয়ে ওখানে সেমিনার করে বলছিলেন, এই লড়াই দুটি ‘সভ্যতার সংঘাত। আমাদের আমেরিকার হেজিমনি শেষ করতে ইউক্রেন পর্যন্ত যেতে হবে’ (স্পাইজেল, ২৫ আগস্ট ২০০৮)।
২০১৪ সালের ১০ জুলাই বিবিসিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে দাগিন আরেকবার খোলামেলাভাবে পুতিনকে ইউক্রেন দখলের আহ্বান জানান। সে সময় তাঁর যুক্তি ছিল, ‘রাশিয়াকে তার নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে ইউক্রেন পেতে হবে।’

দাগিনের কথা রেখেছেন পুতিন। পুতিনের এসব অভিযান দাগিনের সুপারিশমতো ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ গড়ারই পদক্ষেপমাত্র। ক্রিমিয়ার মতো ইউক্রেন অভিযানের পর বিভিন্ন জরিপে রাশিয়াজুড়ে জনগণের মধ্যে পুতিনকে পছন্দের হার বেড়েছে। এভাবেই দাগিন-পুতিন মৈত্রীর ভেতর দিয়ে নতুন শতাব্দীতে নতুন রাশিয়ার নবজন্ম হচ্ছে, যা ১৯৯০ সালে ভেঙেপড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের চেহারার একদম বিপরীত।

ইউক্রেন অভিযান কতটা সুপরিকল্পিত, সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক অবরোধ প্রশ্নে দাগিন-পুতিন জুটির অভিমত দেখেও বোঝা যায়। এ অবরোধকে এই জুটি নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। দাগিনের মতে, এ রকম অবরোধ তাঁদের অনুমানে ছিল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রধানত রাশিয়ার বড় ধনীরা, যারা রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদার গণতন্ত্রী এবং পশ্চিমের মিত্র। তাদের দুর্বল হওয়া রাশিয়ায় ‘দেশপ্রেমিক’দের শক্তি জোগাবে।

শেয়ার করুন: