কেজরিওয়ালের ‘দিল্লি মডেল’ কেন নজর কাড়ছে

অরবিন্দ কেজরিওয়াল হিন্দুত্ববাদের অহিংস সংস্করণ কি না, ‘গান্ধী’দের কোণঠাসা করতে খোদ বিজেপি তাঁকে মদদ দিচ্ছে কি না, এসব প্রশ্ন আছে ভারতে। এ রকম সন্দেহের পেছনে সাক্ষ্যপ্রমাণও আছে। অযোধ্যাসহ বিভিন্ন জায়গার মন্দিরে বেশ খরচপাতি করে দিল্লি থেকে তীর্থযাত্রী পাঠান তিনি। সব ধর্মের মানুষের করের অর্থেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এসব করছেন। বিজেপির প্রিয় স্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও ইতস্তত নন তিনি।

তবে শুধু হিন্দুত্ব বেচে কেজরিওয়াল এগোচ্ছেন না। ওটা তাঁর প্রধান রাজনৈতিক পণ্য নয়। জাতপাতেও আটকে নেই তাঁর সাংগঠনিক ছক। ভারতীয় রাজনীতিতে প্রকৃতই কিছু পরিবর্তন এনেছে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি)।যদিও লোকসভায় তাদের সদস্যসংখ্যা মাত্র ১ কিন্তু এএপি তাদের অধীন থাকা দিল্লিতে নাগরিক জীবনধারায় যেসব পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তাতে নজরকাড়া কিছু বিষয় আছে। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের সঙ্গে যেভাবে উন্নয়নের মিশেল দিচ্ছেন কেজরিওয়াল, সেটা কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি ‘বিকল্প রাজনীতি’ হাজির করেন না; বরং ‘রাজনৈতিক বিকল্প’ হতে চান। তাঁর তীব্র কোনো মতাদর্শ নেই কিন্তু প্রশাসনিক ‘সিস্টেম’ পাল্টানোর জন্য অনেক কর্মসূচি আছে।

ভারতে যাঁরা শুধু ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করতে চান এবং যাঁরা রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করে সফল হতে আগ্রহী, উভয়ের জন্য কেজরিওয়াল খানিক বিপজ্জনক। ইতিহাসচর্চা এবং ধর্মপুস্তকের বাইরে দাঁড় করাতে চান তিনি ভোটের গণিত।

কেজরিওয়ালের রাজনীতি কেন ভোট পাচ্ছে

সরকারি চাকরি ছেড়ে সমাজসংস্কারে নেমেছিলেন কেজরিওয়াল। এ রকম অতীতে অনেকে করেছেন। সফলতা-ব্যর্থতা মিলে বহু নজির আছে এ রকম। কেজরিওয়াল রাজনীতিতে আসার আগে দিল্লিতে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজে নেমেছিলেন, যাকে তিনি ও সহযোদ্ধা মনীশ সিসোদিয়া, প্রশান্ত ভূষণ প্রমুখ বলতেন ‘পরিবর্তনের জন্য জন-আন্দোলন’। সেই আন্দোলন থেকেই আরও অনেকের প্রচেষ্টা মিলে প্রভাবশালী এক দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল তখন কংগ্রেস। সেই থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে কেজরিওয়ালের বিরোধ। পরে কেজরিওয়াল যখন যোগেন্দ্র যাদবসহ এএপির রাজনীতিতে নামেন, তখন দিল্লিতে কংগ্রেসই প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বশেষ পাঞ্জাবেও তা–ই ঘটেছে।

এটা এখন পরিষ্কার, ভারতজুড়ে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের ভোটগুলোই পাচ্ছে কেজরিওয়ালের দল। বিজেপির তাতে আপত্তি নেই। আরএসএস ভারতের সমাজজীবন থেকে কংগ্রেসের বিদায়ই চায়। রাজনৈতিক মূল্যবোধে কংগ্রেস তাদের চিরশত্রু। এএপির মতো দল যতই ভোট বা সংসদীয় আসন পাক, রাজনৈতিক আদর্শবাদের জায়গায় তারা শক্ত কোনো ভিত গড়তে পারেনি এখনো, যা আরএসএস-বিজেপির জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেজরিওয়ালের দলকে পুরোনো কংগ্রেসপন্থীরা কেন ভোট দিচ্ছে?

দেশজুড়ে বিজেপির তীব্র সুনামির মধ্যেও এএপি যে দিল্লিতে টিকে আছে, পাঞ্জাবে জিতেছে এবং গোয়ায় আসন পাচ্ছে, সেটা কেন? ভারতে বিজেপিবিরোধী দলের সংখ্যা তো কম নয়। কেন মানুষ এএপির দিকে আকর্ষিত হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে দিল্লিতে দলটির কিছু কাজকারবারে। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেখানে তারা যেসব সংস্কারমূলক কাজ করছে, ভারতের অন্যত্র মানুষ সে রকম পরিবর্তন চাইছে। রাজনীতিবিদ কেজরিওয়াল মানুষের এই আকাঙ্ক্ষায় ভর করতে চাইছেন। তাঁর আপাতলক্ষ্য আঞ্চলিক দলের পরিচয় মুছে জাতীয় দল হওয়া। যদিও আঞ্চলিক দল হিসেবে তারাই কেবল এ মুহূর্তে দুটি অঞ্চলে সরকার চালাচ্ছে।

আম আদমি পার্টির শিক্ষা সংস্কার

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতোই ভারতেও সচরাচর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে নির্বাচনকালে সামান্যই কথা হয়। সমাজে এসব জরুরি বিষয় হলেও ভোটের রাজনীতিতে সেদিকে মনোযোগ পড়ে না। কেজরিওয়াল ও তাঁর সহকর্মীরা সেই ধারা বদলে দিয়েছেন ‘শিক্ষা প্রথমে’ স্লোগানের মাধ্যমে। ভারতের নানান রাজ্যে এখন দিল্লির সরকারি স্কুলের গল্প। কী করেছে সেখানে এএপি? তারা সরকারি স্কুলগুলোর কাজকর্মে স্থানীয় সমাজকে ব্যাপকভাবে যুক্ত করেছে। শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদের নিয়মিত বৈঠক করাচ্ছে। এসব বৈঠকের কথা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও এফএম রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটিকে মনোযোগী করা হয়েছে পাঠদানের দিকে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে এখন ম্যানেজিং কমিটি চাইলে খণ্ডকালীন শিক্ষক আনতে পারে। কমিটির হাতে কিছু বাজেটও দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষা খাতে সংস্কারের দ্বিতীয় দফায় নজর দেওয়া হয় স্কুল ভবনগুলোতে। উপমহাদেশজুড়ে স্কুল ভবনগুলোর একটা সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করে না, আকর্ষণ করে না। শ্রেণিকক্ষে আলো–বাতাসের অভাব থাকে। টয়লেটগুলো পরিচ্ছন্ন থাকে না। ভালো লাইব্রেরি থাকে না। থাকলেও সেটা খোলা থাকে না। খেলাধুলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এএপি এ রকম সবকিছু পাল্টাচ্ছে অগ্রাধিকার দিয়ে। বিদ্যমান স্কুলগুলোতে তারা কয়েক হাজার শ্রেণিকক্ষও বাড়িয়েছে।

তৃতীয়ত, স্কুলে বছর বছর অযৌক্তিকভাবে বেতন বাড়ানো বন্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য জামিন ছাড়াই ঋণের ব্যবস্থা হয়েছে।

চতুর্থত, এএপি সরকার প্রশিক্ষণের জন্য দেশ-বিদেশে পাঠাচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষাদানের পদ্ধতি পাল্টানো হচ্ছে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে অনেক ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। জোর দেওয়া হয়েছে গুণগত শিক্ষার ওপর। শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে গাণিতিক জ্ঞান এবং উদ্যোক্তাসুলভ বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলায় বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে।

এসব সংস্কারের মিলিত ফল হয়েছে স্থানীয় দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা পুরোনো গুটিকয় ‘উন্নত স্কুল’-এর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সমানতালে এগোচ্ছে এখন। অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেট স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে চলে আসছে।

দিল্লির প্রায় ঘরে কোনো না কোনো শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী থাকায় এএপির শিক্ষা সংস্কারের ঢেউ লেগেছে পাড়ায় পাড়ায়। সবাই তাতে অল্পবিস্তর উপকৃত। রাজ্যের প্রশাসনিক বাজেটের বড় এক অংশ এএপি ঢেলে দিয়েছে শিক্ষা খাতে। প্রতিবছর এই বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। শিক্ষাকে এভাবেই তারা একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত করতে পেরেছে।

স্বাস্থ্য খাতের ‘মহল্লা ক্লিনিক’ মডেল

শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও এএপি কাঠামোগত কিছু সংস্কার ঘটিয়েছে। এ খাতে তাদের সংস্কারের কেন্দ্রে আছে ‘মহল্লা ক্লিনিক’। প্রথমে ১৫৮টি মহল্লা ক্লিনিককে ঘিরে তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ভিত গোছাতে নামে। এ রকম প্রতি ক্লিনিকে একজন চিকিৎসক, একজন ধাত্রী কাম নার্স, একজন ফার্মাসিস্ট এবং ল্যাব সহকারী রাখা হয়। সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত ক্লিনিকগুলো চালু থাকে। কিছু কিছু ক্লিনিক দুই শিফটেও চালানো হয়। সাধারণ রোগবালাই নিয়ে মানুষকে এসব ক্লিনিকে আসতে অনুরোধ করা হয়। কয়েক ডজন পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। ওষুধ ও অন্যান্য সেবা বিনা মূল্যেই দেওয়া হয়।

লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিকর অপেক্ষা ছাড়া এসব ক্লিনিকের বাকি সব কিছুই উপকারী। দরিদ্ররা সময় নষ্ট করে হলেও এসব ক্লিনিকে আসছে। তারা আগে এ রকম রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাসুবিধা কমই পেত।

অনেক মহল্লা ক্লিনিক বসানো হয় জাহাজে করে মালামাল পরিবহনের কনটেইনারে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় ক্লিনিক বসানোর মতো জায়গা খোঁজা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তার বরাদ্দ চেয়ে সময় নষ্ট করার চেয়ে এভাবে সমস্যার চটজলদি সমাধান করা হয়েছে।

শেয়ার করুন: