শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দেশটির প্রতিবাদী মানুষের বড় এক বিজয়। কিন্তু পাশাপাশি সেখানে কারফিউ জারি হয়েছে। কারফিউর অন্তত একটা মানে প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ে সেখানে মানুষ যথেষ্ট সন্তুষ্ট নয়। মানুষের চাওয়া আরও বড় কিছু, আরও বেশি কিছু। কারফিউ উঠে গেলে মানুষ সেটা জানাবে। দেশটি এ মুহূর্তে এমন এক গর্ভযন্ত্রণায় কাতর, যার আপাতনিরাপদ ফয়সালা নেই। জন-অসন্তোষকে সফল গণ-আন্দোলনে রূপান্তরের আমূল পরিবর্তনবাদী রাজনৈতিক শক্তি নেই লঙ্কার মাঠে।
ক্ষমতা থেকে রাজাপক্ষেরÿ বংশের যে কারও বিদায় শ্রীলঙ্কায় বহুজনের জন্য আনন্দদায়ক অগ্রগতি। কিন্তু মাহিন্দা রাজাপক্ষে ÿবাড়ি ফিরে গেলেও সংকটের সামান্যই জট খুলবে। দেশটির বর্তমান সংকটের বড় এক উৎস নির্বাহী প্রধান ‘প্রেসিডেন্ট’। তাঁর হাতে যাবতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে আছে সাংবিধানিকভাবে। এর সংস্কার বিষয়ে এখনো কোনো জাতীয় ঐকমত্য হয়নি। প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করতে আগ্রহী নন—যদিও তিনি কৌশলগতভাবে নমনীয় অবস্থান নিয়ে আছেন। তাঁর পেছনে সামরিক আমলাতন্ত্রের মদদ আছে। সামরিক বাহিনীতে তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাবও আছে।
সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা রাজাপক্ষেদের শাসনে ত্যক্তবিরক্ত হলেও তাদের একাংশ এটাও চাইছে—অন্তত একজন রাজাপক্ষের ক্ষমতার চৌহদ্দিতে থাকুক। এর মধ্যেই হাম্বানটোটায় রাজপক্ষের রাজনৈতিক বংশের গোড়াপত্তনকারী—মাহিন্দা ও গোতাবায়ার পিতা ডন এলোইন রাজাপক্ষের স্মৃতিসৌধ জনতা উপড়ে ফেলেছেন, যা সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সিংহলি রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাইছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন সাজিথ প্রেমাদাসা। তিনি আরেক পলিটিক্যাল ডাইনেস্টির লোক। রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে। সাজিথ সংস্কারপন্থী। তাঁর প্রতি তামিলদের সমর্থন আছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় অপর নেতা রনিল বিক্রমাসিংহের সংস্কার প্রস্তাবে প্রবল সমর্থন দেখা যাচ্ছে না। জনতা বিমুক্তি পেরামুনাসহ অন্য বিরোধী দলগুলোও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে ব্যর্থ।
এর মধ্যে জনবিক্ষোভ, রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রধানমন্ত্রীর বিদায় এবং কারফিউ বড় খবর হলেও দেশটিতে গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। খাদ্যপণ্য ও ওষুধের সংকট তো আছেই। আইএমএফ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও অর্থনৈতিক সংস্কারও চাইছে। যে নির্মম অর্থনৈতিক সংস্কার এগিয়ে নেওয়া কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। আইএমএফ পরোক্ষেÿ সেটাই গড়তে বলছে রাজনীতিবিদদের। সেটার বাস্তবায়ন স্বভাবত কঠিন। যদিও তার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে সামরিক বাহিনীর সরকার। তাতে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান নয়, কেবল ধামাচাপাই ঘটতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্রমাগত দেশটির অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা বলছে। কেউই এর পেছনের সামাজিক কারণটির কথা বলছে না। শ্রীলঙ্কা কেবল তীব্র ডলারসংকটে ভুগছে না, সামাজিক পুঁজির সংকটেও ভুগছে। যে সংকটের শুরু রাজাপক্ষেদের হাত ধরেই, তবে আজ থেকে বহু আগে, শতাব্দীর প্রথম দশকে।
আজকে দেশটির বুদ্ধিজীবীরা সংকটের সমাধান হিসেবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের যে কথা বলছেন, ২০ বছর আগে তামিলরা সে কথা বলেই মার খায়। ২০০৯ সালে তামিল সশস্ত্রতা নির্মূলের মাধ্যমে সিংহলিরা যে বিজয় উৎসব করেছে, প্রকৃত প্রস্তাবে সেখান থেকে দেশটির আজকের সংকটের শুরু। আজকের মাহিন্দা সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং গোতাবায়া ছিলেন প্রতিরক্ষাসচিব। তখন থেকে রাজাপক্ষেদের সিংহলিরা ‘টারমিনেটর’ বলতে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার করুণ প্রতিদানে তারা মানসিকভাবে বেশ বিধ্বস্ত এখন। এটা তামিল রাজনৈতিক মনীষার কাছে সিংহলি উগ্রতার এক বড় পরাজয়ও বটে।
তামিলদের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা দমনের ভেতর দিয়ে শ্রীলঙ্কায় দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। দ্বিতীয়ত, সেই জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে রাজাপক্ষেÿ পরিবারের হাতে সিংহলিরা যাবতীয় ভবিষ্যৎ সঁপে দেয়। এর সুযোগ নিয়ে রাজাপক্ষেরা দেশটির শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় ধরন থেকে একচেটিয়া ক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেনশিয়াল ধরনে রূপান্তর করে নেন। এভাবে দেশটিতে প্রশাসনিক পিছু হটা সম্পন্ন হয় পুরো ৩৬০ ডিগ্রি মাত্রায়। যেখানে আগের সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান তামিলরা বাড়তি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাইছিল, সেখানে রাজাপক্ষেরা ঘটান উল্টো। আবার একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী—সবই আসতে থাকে একই পরিবার থেকে। এ সময়ের শাসন–সংস্কৃতির আরও দুটি বড় উপাদান ছিল কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে মানবাধিকারের ইচ্ছামতো দলন এবং খেয়ালখুশিমতো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
এ রকম এক অবস্থারই দীর্ঘ ফসল আজকের লঙ্কা, যাকে ব্রিটিশরা বলত ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’। এই দেশকে আগেকার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিসরে নেওয়ার প্রধান শর্ত সিংহলিদের মধ্যে এ রকম উপলব্ধি হওয়া যে জাতিগত উন্মাদনায় পড়ে গত দশকে তারা ভুল করেছে। এ রকম উপলব্ধি তৈরি আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। লঙ্কার নাগরিকদেরই এই জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদরেখা মুছতে হবে। কিন্তু কাজটি দুরূহ।
আপাতত সেখানে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন হলেই হয়তো মানুষ ঘরে ফিরে যাবে। সেটাও কি হবে? বলা মুশকিল। এ রকম দাবি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও ঐক্য নেই। যদিও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা রাস্তায় আছেন।