সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, বিদেশ থেকে দিনে গড়ে দশজন বাংলাদেশি শ্রমিক-কর্মচারীর মৃতদেহ আসে। এই হিসাবে বছর বছর লাশ হয়ে আসা বাংলাদেশি কর্মজীবীর সংখ্যাটা বেশ বড়। এ রকম মৃত মানুষের মধ্যে কাতার থেকে গত এক দশকে এসেছে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশির লাশ। এদের একাংশ সেখানে বিশ্বকাপ ফুটবলের অবকাঠামো তৈরির সময় মারা গেছে বলে অনুমান করছে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থা। এ রকম মৃত ব্যক্তির তালিকায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। এদের শ্রমে গড়া দালান-কোঠাতেই হবে ফিফা বিশ্বকাপ। ফুটবলের এই বিশাল আয়োজনকে ঘিরে ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়েছে।
এই আয়োজন কেবল কাতারের অর্থনীতিতেই দীর্ঘ মেয়াদে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করবে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোও প্রাইজমানি হিসেবে নেবে ৪৪০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশের শ্রমিক—যাঁদের রক্ত-ঘামে বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম ও বাড়িঘর গড়ে উঠল—তাঁরা ফিফা ও এই ফুটবল-জ্বর থেকে কী পাবেন?
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয়-ব্যয়ের গল্প
এই লেখা তৈরির সময় ক্ষণ-গণনার হিসাবে বিশ্বকাপ শুরু হতে মাত্র ২০০ দিন বাকি। চূড়ান্ত মোকাবিলার আগে অংশগ্রহণকারী ৩২ দেশ এখন শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে আছে। আর তাদের নিয়ে বিশ্বজুড়ে নেমে পড়েছেন প্রচারমাধ্যমের কর্মীরা। প্রায় ৪০০ কোটি মানুষকে এই আয়োজনে শরিক করার লক্ষ্য সবার। এবারের বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ এক দিক হিসেবে কাতার মনে করছে, এই আয়োজন আরব জনপদের সঙ্গে বাকি বিশ্বের দূরত্ব ঘোচাবে।
২২ দেশের বিশাল ‘আরব বিশ্ব’-এ ফুটবলের এ রকম বৈশ্বিক আয়োজন এই প্রথম। মাত্র ২০-৩০ লাখ অধিবাসীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও—ধরে নেওয়া হয়, কাতার এত বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের অধিকার পেয়েছে মূলত অর্থের জোরে। বিশ্ব ফুটবলের মুরব্বিরা ভেবেছিলেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে কাতার এই মেগা আয়োজনের যোগ্য হয়ে উঠবে। তাঁদের অনুমান মিথ্যা হয়নি। গ্যাসসম্পদে ধনী এই দেশ বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি পেয়ে ক্রীড়া খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বড় অঙ্কে ভবিষ্যৎ মুনাফারও স্বপ্ন দেখছে। খেলা যদিও হবে স্টেডিয়ামে—কিন্তু খাবার থেকে মিডিয়া পর্যন্ত বহু খাতে কাতারের অর্থনীতিতে বাড়তি প্রাণচাঞ্চল্য এখন। বিশ্বকাপের আগেই তাদের আয় শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন দিক থেকে। গত বছরই সেখানে হয়ে গেছে ফিফা-আরব কাপ। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রীড়া অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে তারা ইতিমধ্যে। আসন্ন আয়োজনের ভেতর দিয়ে কাতারের বিশ্ব ইমেজও অনেক বাড়বে। আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার পথে স্থানীয় শাসক পরিবারের সেটাও বিশেষ দরকার। কেবল সম্পদশালী হয়ে থেমে থাকতে চাইছে না তারা আর।
বাংলাদেশি শ্রমজীবীদেরও হিস্যা আছে যে আয়োজনে
কাতার এক অর্থে ‘বিদেশি’দের দেশ। এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই বিদেশি শ্রমজীবী-কর্মজীবী। তাদের মধ্যে আবার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ। রুটিরুজির সন্ধানে তারা ওখানে আছে। বিশ্বকাপের অনুমতি পেয়ে বহু ধরনের নতুন ভবন তৈরির কর্মসূচিতে নেমেছিল কাতার। বিদেশি ফুটবলপ্রেমীদের থাকার ব্যবস্থা করতে কাতারকে হোটেল–সামর্থ্য বাড়াতে হয়েছে কয়েক গুণ। এ রকম সব নির্মাণযজ্ঞের ক্ষুধা মেটাতে আফ্রিকার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া থেকে নতুন করে বিপুল শ্রমিক গেছেন সেখানে। তাঁদেরই একাংশ হিসেবে আসন্ন ফিফা বিশ্বকাপের কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন বাংলাদেশের শ্রমজীবীরাও।
সরকারি হিসাবে আট লাখের অধিক বাংলাদেশি কাজে আছেন কাতারে। কিন্তু এ রকম শ্রমজীবীদের নিজ দেশে বা আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী কোনো সংগঠন নেই—যেমনটি আছে ফুটবলের জন্য ফিফা। ফলে ফিফার পণ্য হিসেবে ‘বিশ্বকাপ’ নিয়ে উন্মাদনা শুরু হলেও বিশ্বকাপের অবকাঠামো গড়তে কাতারে শ্রম বেচতে যাওয়া শ্রমিকদের কথা শোনার মানুষ কম।
কাজের চাপ আর অসহনীয় শ্রমঘণ্টা
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান প্রায় এক বছর আগে (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১) কাতার থেকে সংগ্রহ করা উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিল, বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণকাজের মাঝের সময়টিতে কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশের শ্রমজীবী মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। গত এক বছরে সংখ্যাটা বাড়ার কথা। এ রকম মৃত মানুষদের সবাই–ই যে স্টেডিয়াম বা খেলোয়াড়দের থাকার জায়গা তৈরি করতে গিয়ে মারা গেছেন, তা নয়। কিন্তু কেউ কেউ ও রকম প্রকল্পে ছিলেন। ফিফার বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ে স্টেডিয়াম, হোটেল, আবাসিক এলাকা গড়তে গিয়ে এসব শ্রমিককে ব্যাপক চাপের মধ্যে খাটতে হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, কাতারে বিদেশি শ্রমিক অনেকেই পাসপোর্ট আটকাবস্থায় ‘জোরপূর্বক শ্রম’ দিতে বাধ্য হয়েছেন (বিবিসি, ৫ এপ্রিল ২০২২)। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। সচরাচর কয়েক লাখ টাকা খরচ করে এরা কাজের সন্ধানে কাতারে গিয়েছেন। যেভাবে যাচ্ছেন অন্যান্য দেশেও। সেই টাকা তোলার লক্ষ্যে কাজের শর্ত অসহনীয় হলেও অনেক সময় এসব শ্রমিককে কাজ করে যেতে হয়। ৭ এপ্রিল মিডল ইস্ট আই লিখেছে, বিশ্বকাপের অবকাঠামোর পাহারায় এমন শ্রমিকেরাও ছিলেন এবং আছেন, যাঁদের সপ্তাহে সাত দিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব নিয়ে ২০১৯ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কাতারে অভিবাসী শ্রমিকেরা একদফা কর্মবিরতিতেও শামিল হয়েছিলেন, যা ছিল বিরল ঘটনা। দেশটির আইনে অভিবাসী শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন ও ধর্মঘট ডাকায় বিধিনিষেধ আছে।
খেলোয়াড়দের কষ্টের কথা সবার মাথায় আছে, শ্রমিকদের কথা নয়
কাতারে জুন থেকে আগস্টে এত গরম থাকে (৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) যে দুপুরে দীর্ঘসময় নির্মাণ খাতে শ্রমসাধ্য কাজ করা দুরূহ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ফিফার চাহিদামতো ভবনাদি গড়তে অনেক অভিবাসী শ্রমিককে তখনো কাজ করতে হয়েছে। তাঁদেরই ক্ষুদ্র একাংশের শরীর সেই চাপ সইতে পারে না বলেই মারা যায়—এমনই দাবি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের। মৃত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব সংগঠন এ রকম দাবি তুলেছে। পুনঃ পুনঃ দাবির মুখে কাতার সরকার এ বিষয়ে প্রতিকারমূলক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উল্লেখ্য, গরমে খেলোয়াড়দের কষ্ট হবে বলেই বিশ্বকাপের মৌসুম জুন থেকে বদলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে নেওয়া হয়। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের আরামের জন্য কুলিং সিস্টেমও থাকছে স্টেডিয়ামে। অথচ এসব স্টেডিয়াম বানানোতে শ্রমিকদের তীব্র তাপদাহেও কাজ করতে হয়েছে অনেক সময়।
নরওয়েতে দেখা গেছে ফুটবলাররা কাতারের স্টেডিয়াম–শ্রমিকদের এই অবস্থা নিয়ে ফিফাকে মনোযোগী হতে টি-শার্ট গায়ে চড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। হয়তো এ রকম প্রতিবাদ আরও হবে।
‘নগণ্য ক্ষতি’!
কাতার সরকার বিদেশি শ্রমিকদের দুর্দশার কথা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না। তাদের কথা হলো, লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিকের অতি নগণ্য অংশ এ রকম পরিস্থিতির শিকার (ইএসপিএন, ২৫ মার্চ ২০২১। মানবাধিকারকর্মীরা বলতে চাইছেন, কাতারের এই অবস্থার দায় কিছুটা ফিফার ওপরও বর্তায়।
ফিফা প্রাথমিকভাবে কাতার বিশ্বকাপের নির্মাণশ্রমিকদের দুঃখ-যন্ত্রণার বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে নানান সংবাদমাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিবেদন দেখে তারা এ বিষয়ে সংলাপে বসে। এ রকম সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে গত ১৪ মার্চ। ফিফা সাধারণভাবে মনে করছে, শ্রম অধিকারে কাতারে অনেক অগ্রগতি ঘটেছে। বলা বাহুল্য, ফিফার সঙ্গে কাতারের বন্ধন বেশ শক্তিশালী। এর পেছনে আছে বাণিজ্যিক স্বার্থ। আসন্ন বিশ্বকাপে সব মিলে ফিফার আয় হবে ছয়-সাত বিলিয়ন ডলার। এ রকম বিশাল অর্থনীতিতে কিছু দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষয়ক্ষতি হবে—এ অস্বাভাবিক নয়। তবে নিঃসন্দেহে এ অবস্থা বিশ্বকাপসহ আন্তর্জাতিক বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজনের ধরনে সংস্কার দাবি করছে। বিশেষ করে ফিফা যখন বলছে, ‘ফুটবল হলো একটা শুভশক্তি।’
কিছু পরিবার যখন ভেজা চোখে আনন্দে শামিল হবে
অভিবাসী শ্রমিকদের বিষণ্নতা কেবল কাতার বা মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বরং বিশ্বজুড়ে। বিশ্বকাপের কারণে কাতারের অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি মুহূর্তে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের নজরে এলেও বহু দেশে বহুকাল ধরে তাঁরা খারাপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অনেকের কাছে এটা স্বাভাবিক দৃশ্য।
বিশ্বজুড়ে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ কোটি এখন। এসব শ্রমিকের মধ্যে বাংলাদেশিদের বড় হিস্যা আছে। কোভিডের সময় দেশে এদের কারও কারও বাড়িতে লাল-পতাকা টাঙানো হয়েছিল। সেই তিক্ত স্মৃতি এসব শ্রমজীবীর যন্ত্রণার প্রতীকী এক অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। যদিও তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার বিশালত্ব নিয়ে অনেক গর্ব শোনা যায় বিভিন্ন তরফ থেকে। অথচ এসব শ্রমিকের না আছে সংঘবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন, না আছে ভোটাধিকার, না আছে দেশে ফিরে পুনর্বাসনের সুযোগ, না আছে তাঁদের অবস্থা পাল্টানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এত সব ‘নেই’-এর ভেতরই বিশ্বকাপের সময় কিছু পরিবারের মনে পড়বে—তাদের প্রিয়জনের শেষনিশ্বাস চাপা পড়ে আছে এই বৈশ্বিক আনন্দের নিচে।