প্রশ্ন : কোন দিকে যাচ্ছে মিয়ানমারের রাজনীতি?
আলতাফ পারভেজ : আমি মিয়ানমারকে বার্মা হিসেবে উল্লেখ করি। কারণ সামরিক বাহিনী জনমতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একদা দেশটির নাম পরিবর্তন করেছিল। এখনো দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে হতাশা ও অনিশ্চয়তাই বিরাজ করছে। অং সান সু চি অনেক আশাবাদ তৈরি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কয়েক দশকের গণতন্ত্রের সংগ্রামের ফসল ছিল নির্বাচন এবং সূচির দল এনএলডির ক্ষমতায় আসা। মানুষ নির্বাচনে সেনাশাসন ও সেনাকর্তৃত্বের বিপক্ষে এবং রাজনৈতিক-সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে রায় দেয়। প্রত্যাশিত সেই সাংবিধানিক সংস্কার হয়নি। সু চি এমন সংস্কার করতে সক্ষম বলেও এখন আর কেউ মনে করছে না। বার্মা ইউনিয়নে বামার ছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তার ন্যায্য অধিকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য। সেনাবাহিনী এমন সংস্কারের বিপক্ষে, বর্তমান সংবিধান তাদেরই প্রণীত। এই সংবিধান দেশটির নীতিনির্ধারণে তাদের খবরদারিত্বের বিপুল সুযোগ করে দিয়েছে। সেনাবাহিনী প্রণীত নাগরিকত্ব আইনের কারণেই রোহিঙ্গারাও নাগরিকত্ব হারায়।
প্রশ্ন : পশ্চিমের গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা বিষয় এত বেশি আলোচিত হওয়ার কারণ কী?
পারভেজ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমের গণমাধ্যমের সাড়া অস্বাভাবিক ছিল না। এটা তো ব্যাপক কাভারেজ পাওয়ার মতোই ঘটনা ছিল। গণহত্যার মধ্যদিয়ে ভয় দেখিয়ে একটি দেশের শাসকরা তাদেরই ১০ লাখ নাগরিককে তাড়িয়ে দিচ্ছে- এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ছিল। তবে যেহেতু চীন বার্মা বিশেষ বন্ধু, সেই কারণেও পশ্চিমের প্রচার মাধ্যম এ ক্ষেত্রে বাড়তি আগ্রহী হয়ে থাকবে। তারা বার্মা-চীন সম্পর্কের মানবতাবিরোধী ধরনটি স্পষ্ট করতে চাইছিল।
প্রশ্ন : সেনানিয়ন্ত্রণ ও সামরিক বাহিনী প্রভাবিত শাসন থেকে উত্তরণের পথে কতটুকু এগোতে পারল মিয়ানমার?
পারভেজ : এক কদমও এগোয়নি। প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণে সেনানিয়ন্ত্রণ কমাতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এর জন্য খোদ সশস্ত্র বাহিনীরই সম্মতি লাগবে। পার্লামেন্টে রয়েছে তাদের ২৫ ভাগ আসন। সশস্ত্র বাহিনী তাদের তৈরি সংবিধান সংশোধন করতে আগ্রহী হবে না, যদি না বেসামরিক তরফ থেকে চূড়ান্ত চাপ থাকে। কিন্তু অং সান সু চি সেই রকম কোনো অবস্থান নিতে চাইছেন না। বরং দেশটির নীতিনির্ধারণে সেনাবাহিনীর ইচ্ছেই চূড়ান্ত হয়ে আছে।
প্রশ্ন : চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। আপনার বইতে তার বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। দেশটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের চলমান সংঘাত এবং এর ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ার কারণ কী?
পারভেজ : বার্মাজুড়ে নানারূপে কমবেশি গেরিলা যুদ্ধ আছে। তারপরও দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ যাচ্ছে অনেক। প্রায় পুরো দুনিয়া প্রকাশ্যে বা গোপনে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে চাইছে। এর কারণ হলো, দেশটিতে রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ। এত দিন চীন এগুলো সস্তায় ভোগ করেছে। অবরোধ উঠে যাওয়ার পর এখন অন্যরাও ভোগ করতে চাইছে। দীর্ঘ অবরোধের কারণে বার্মা পণ্য বাজারটিও পশ্চিমের কোম্পানিগুলোর কাছে অধরা ছিল এত দিন। এখন অবরোধ ওঠা মাত্র তারাও এই বাজারে ঢুকতে চাইছে। বার্মা প্রতি পশ্চিমের আগ্রহের আরেকটি কারণ চীনকে কোণঠাসা করতে তারা বার্মা ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি সব কিছুতে সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে চাইছে। আগ্রহোদ্দীপক ঘটনা হলো, এত বড় রোহিঙ্গা সংকটের পর বাংলাদেশ-বার্মা বাণিজ্যও ব্যাপকভাবে কমেনি।
প্রশ্ন : রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের পেছনে ধর্মীয় কারণ কতটা কাজ করেছে?
পারভেজ : যদিও সরাসরি নিপীড়নের ঘটনায় যুক্ত মূলত সশস্ত্র বাহিনী, কিন্তু তার পক্ষে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের সমর্থন ছিল। গত কয়েক বছর ধরেই বৌদ্ধ উগ্রবাদিতা বাড়ছে বার্মা। বিগত নির্বাচনে তাদের কারণে কোন দলই একজন মুসলমানকেও মনোনয়ন দেয়নি। মুসলমান ও বাংলাদেশকে সেখানে বিশাল এক ঘৃণার বিষয় বানানো হয়েছে। এই ঘৃণাচর্চায় সেনাবাহিনীর ইন্ধন আছে। আবার সেনাবাহিনীর কাজেও বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের সমর্থন রয়েছে। বার্মায় রোহিঙ্গা ছাড়াও আরো যেসব মুসলমান জাতিসত্তা রয়েছে তারাও এরূপ ঘৃণাচর্চার করুণ শিকার।
প্রশ্ন : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের অবস্থানটা কী? বিশেষ করে ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা।
পারভেজ : ভারত ও চীন এ ইস্যুতে সরাসরি খোলামেলা বার্মাকে সমর্থন দিচ্ছে। চীনের সমর্থন বার্মা খুব কাজে লেগেছে জাতিসংঘে পশ্চিমাদের মোকাবিলায়। রাশিয়াও রোহিঙ্গা প্রশ্নে বার্মা শাসকদের অবস্থান সমর্থন করে। জাপানও অনেকাংশে বার্মা সমর্থক। সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বার্মা দারুণ কূটনীতিক সফলতা দেখিয়েছে বলা যায়। এত নির্মম এক ঘটনার পরও আন্তর্জাতিক পরিসরে সে কোণঠাসা এমনটি বলা যায় না। আসিয়ানে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া গণহত্যার তদন্ত ও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার দাবি তুললেও থাইল্যান্ডসহ অপর কয়েকটি দেশ বার্মাকে সমর্থন করছে। মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া ছাড়া অন্যরা এ বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাশিত মাত্রায় সোচ্চার নয়। এর পেছনে রয়েছে চীনের প্রভাব। জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবস্থান নিলেও চীনের বিরোধিতার কারণে তাদের কোনো উদ্যোগ সফল হয়নি।
প্রশ্ন : মিয়ানমারে সংগ্রামরত অন্যান্য জাতি আর রোহিঙ্গাদের অবস্থার মধ্যে তফাৎ কোথায়?
পারভেজ : অন্যরা অনেকাংশেই জায়গায় দাঁড়িয়ে লড়তে পারছে। রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া। এমনকি রোহিঙ্গারা নিয়মতান্ত্রিকভাবেও আন্দোলন সংগ্রামের সুযোগ পায়নি। অন্যরাও সেটা না পেয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছে বহু আগেই। আরাকানে এখন রাখাইনদের সঙ্গে বার্মা বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। শ্যান ও কাচিনেও যুদ্ধাবস্থা। কারেনদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চলছে। সামগ্রিকভাবে বার্মা ইউনিয়নে বামার ছাড়া অন্য সবাই কমবেশি অসুখী। স্বাধীনতাকালীন প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি তাদের সঙ্গে। দেশটির সম্পদে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর হিস্যা নেই।
প্রশ্ন : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সফলতার জন্য বাংলাদেশের বিকল্প কোনো চিন্তার প্রয়োজন আছে কি না?
পারভেজ : প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি নেই। কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যায়নি। যেতেও চাচ্ছে না। এখন আবার ভারত থেকেও কয়েক হাজার এসেছে শোনা যাচ্ছে। এরইমধ্যে গত এক বছরে প্রচুর নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। বাংলাদেশ ক্রমে এক বিশাল দায়ে পড়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল। তাই আপাতত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের কোনো লক্ষণ নেই। পরপর দুই দফা তারিখ নির্ধারিত হয়েও সুফল আসেনি। প্রত্যাবর্তনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, বার্মা সেই পরিবেশ তৈরি করেনি বা করতে চায় না। বাংলাদেশের সামনে পথ একটিই, তার অবস্থানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানো। লাখ লাখ শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক জনমত সংগ্রহে মরিয়া চেষ্টা ছাড়া বার্মা রোহিঙ্গাদের সহজে ফেরত নেবে না। আর আরাকানে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে চীন ও ভারতও বার্মা পাশেই থাকবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শক্তিশালী মিত্র খুঁজতে হবে।